তিতু বলল, হ্যাঁ। কেউ দেখে না।
রিতু বলল, আমরা গ্রামে না আসলে কেউ কোনোদিন জানতাম না চাঁদ এত সুন্দর।
সবাই মাথা নাড়ল। টিয়া বলল, ঐ গাছে জোনাকি পোকাগুলো দেখছ? এক সাথে জ্বলছে এবং নিভছে? কী সুন্দর!
টিটন এটার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে যাচ্ছিল কিন্তু সবাই সৌন্দর্য দেখে এত মুগ্ধ টিটনের মনে হলো, এখন কেউ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনতে চাইবে না, তাই শেষ পর্যন্ত আর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করল না।
তিতু বলল, বাতাসে নারকেল গাছের পাতাগুলো নড়ছে আর কী সুন্দর শব্দ হচ্ছে দেখেছ? শির শির এক রকম শব্দ!
সবাই মাথা নাড়ল, টিয়া বলল, পাখির ডাকগুলো শুনছ? কী রকম অদ্ভূত পাখির ডাক! মনে হয় অন্য দুনিয়া থেকে ডাকছে।
টিটন বলল, বাতাসটা একদম পরিষ্কার। পিওর অক্সিজেন। একবার শ্বাস নিলেই ফুসফুস পরিষ্কার হয়ে যায়।
রিতু বলল, আর দেখেছিস কী সুন্দর একটা বাতাস আসছে। বাতাসের মাঝে কেমন যেন একটা ফুলের গন্ধ।
তিতু বলল, চারিদিক একেবারে নীরব। কোনো শব্দ নাই। গ্রামের সব মানুষ মনে হয় সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে যায়।
এরকম সময় মিঠুন বলল, রিতু আপু। একটা ভূতের গল্প বলবে?
রিতু বলল, ভূতের গল্প? এখন?
হ্যাঁ। এখন।
টিয়া বলল, অনেক ভয় করবে।
মিঠুন বলল, ভয় পাওয়ার জন্যই তো ভূতের গল্প। বল না আপু। প্লিজ।
তিতু আর টিটন বলল, হ্যাঁ আপু, বল।
রিতু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, আমি যখন আরো ছোট, তোদের জন্ম হয় নাই কিংবা জন্ম হলেও তারা খুবই ছোট তখন নানি একটা গল্প বলেছিল। সেই গল্পটা বলি?
হ্যাঁ হ্যাঁ বল।
এইটা নানি শুনেছিল তার মামার কাছ থেকে। অনেকদিন আগের কাহিনি তখন রেডিও টেলিভিশন ছিল না, ইলেকট্রিসিটি ছিল না গাড়ি ঘোড়া ছিল না, মানুষেরা একটা গ্রামে থাকত, গ্রামের বাইরে কিছু আছে কিনা সেইটাও গ্রামের মানুষেরা জানত না। এইটা সেই সময়ের গল্প।
মিঠুন উৎসাহ নিয়ে বলল, বল রিতু আপু বল।
গেস্ট হাউজের সিঁড়িতে অন্ধকারে পাঁচজন বসে আছে, চাঁদের আলোতে সবাইকে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে সুনশান নীরবতা, শুধু মাঝে মাঝে রাত ডাকা পাখির শব্দ। হঠাৎ হঠাৎ বহু দূর থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। এর মাঝে রিতু নানির কাছ থেকে শোনা গল্পটা বলতে শুরু করল, ঠিক নানি যেভাবে বলেছিল সেভাবে:
আমার ছোট মামা মফিজের বয়স তখন বেশি না। সেই সময় স্কুল কলেজ ছিল না তাই কেউ লেখাপড়া করত না। মফিজ ও লেখাপড়া করে নাই। বাবার জমি ছিল সেখানে চাষবাস করে দিন কেটে যেত। মফিজের খুব মাছ ধরার সখ। যেই সময়ের কথা বলছি তখন কেউ বাজার থেকে মাছ কিনতো না। বাড়িতে পুকুরে মাছ থাকত, খালে মাছ থাকত, নদীতে মাছ থাকত আর সবচেয়ে বেশি মাছ থাকত বিলে। যার মাছ খাওয়ার সখ থাকত তারা খাল বিল নদী কিংবা পুকুর থেকে মাছ ধরে আনতো।
মফিজের একজন বন্ধু ছিল সুলতান। সে মফিজ থেকে এক দুই বছর বড়। মফিজের মতো সুলতানেরও খুব মাছ ধরার সখ। দুই বন্ধু মিলে মাঝে মাঝেই বিলে মাছ ধরতে যেত। সেবার খুব শীত পড়েছে, এই শীতের মাঝে দুই বন্ধু সুলতান আর মফিজ ঠিক করল তারা বিলে মাছ মারতে যাবে। তবে তারা যাবে গোপনে।
গোপনে যাওয়ার একটা কারণ আছে, তারা ঠিক করল তারা মাছ মারবে বাঘামারি বিলে। বাঘামারি বিল বাড়ি থেকে অনেক দূরে, নৌকা করে যেতেই ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। দুইজন জোয়ান মানুষ ঘণ্টাখানেক নৌকায় যাওয়া তাদের জন্য কোনো ব্যাপার না। কিন্তু এই বিলটার দোষ আছে, রাত্রিবেলা অনেক দূর থেকে এই বিলে মানুষের কান্না শোনা যায়। অমাবস্যার সময় বিলের মাঝে হালকা সবুজ রঙের আলো দেখা যায়, আলোগুলো বিলের মাঝে ঘুরে বেড়ায়। এই বিলে দিনের বেলাতেই মানুষ যেতে ভয় পায়, রাতের বেলা তো প্রশ্নই আসে না।
কিন্তু সুলতান আর মফিজ দুইজনেরই অনেক সাহস। দুইজন একসাথে থাকলে জীন ভূত কোনোটাই তারা ভয় পায় না। তবে বাড়ির মুরব্বিরা শুনলে তাদের যেতে দিবে না। তাই তারা ঠিক করলো কাউকে না জানিয়ে গোপনে যাবে। মফিজ ঠিক করল, এই রাতে সে বাইরের বাংলা ঘরে ঘুমাবে। মাঝরাতে সুলতান এসে ঘরের দরজায় শব্দ করলেই সে উঠে যাবে। তারপর দুই বন্ধু রওনা দিবে বাঘামারি।
যেভাবে ঠিক করেছিল ঠিক সেভাবে মফিজ বাংলা ঘরের চৌকিটাতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছে। অনেক শীত পড়েছে। সাথে কুয়াশা। এক কাঁথাতে শীত মানে না। তাই মফিজ মাটির মালসাতে একটু আগুন করে নিয়েছে। আগুনে হাত পা সেঁকে একটু গরম হয়ে সে ঘুমাতে গেছে। কাছেই মালসাটা রেখেছে, তুষের আগুন সেখানে ধিকি ধিকি করে জ্বলছে।
সেই সময় কোনো ঘড়ি ছিল না। রাত দুপর হয়েছে না ভোর রাত হয়েছে পুরোটাই অনুমানের উপর। আকাশে চাঁদ থাকলে চাঁদটা দেখে সময়ের আন্দাজ করা যেত কিন্তু রাতটা অমাবস্যার তাই আকাশে চাঁদ নাই।
ভোর রাতে দরজায় শব্দ হলো, মফিজ বুঝল সুলতান এসে গেছে। মফিজ বিছানা থেকে নেমে বলল সুলতান ভাই, আসছ?
বাইরে থেকে সুলতান একটা অস্পষ্ট শব্দ করল। চাদর মুড়ি দিয়ে থাকলে কথাবার্তা ভালো বোঝা যায় না তাই মফিজ বেশি অবাক হলো না।
মফিজ দরজা খুলে দিল, বাইরে অন্ধকারে সুলতান দাঁড়িয়ে আছে, অনেক শীত, তাই চাদর মুড়ি দিয়ে চোখ মুখ মাথা সব ঢেকে রেখেছে। অন্ধকারের কারণেই কিনা কে জানে সুলতানকে দেখতে অনেক খাটো লাগছে কিন্তু মফিজ সেটা নিয়ে মাথা ঘামালো না। বলল, সুলতান ভাই, হুঁকোটা ধরিয়ে দুটো টান দিয়ে যাই। শরীরটা গরম হোক।