আপনা গো কথা, মানে রাজাকারের কথা?
আজহার আলী কায় আরো দুইটা টান দিয়ে বলল, হু।
তাতে সমস্যা কী? এখন তো আমাগো সরকার।
আজহার আলী ধমক দিয়ে বলল, আরে ছাগলের বাচ্চা, সরকার আমাগো হইছে তো কী হইছে, পাবলিক কী আমাগো? পত্র পত্রিকা কী আমাগো? টেলিভিশন কী আমাগো? বেবাক মানুষ কে সুযোগ পাইলেই আমাগো গাইল পাড়ে, দেখস না?
মতি আর খলিল মাথা নাড়ল, বলল, তা ঠিক। কিছু একটা হইলেই গাইল পাড়ে, কয় রাজাকারের বাচ্চা রাজকার।
আজহার আলী গলা নিচু করে ষড়যন্ত্রীর মতো বলল, ফজলু চেয়ারম্যান খুন হইছে তাই ঠিক করছিলাম চেয়ারম্যান ইলেকশান করুম। এই হচ্ছে সুযোগ। কিন্তু হঠাৎ করে হলের যদি মনে পড়ে সংগ্রামের সময় আমি রাজাকার কমান্ডার ছিলাম পাবলিক আমারে ভোট দিব?
মতি বলল, সেইটা অবশ্য সঠিক কথা কইছেন।
এখন ঢাকার চার পাঁচটা পোলাপান যদি গেরামে ঘুরে আর একজন মুক্তিযোদ্ধারে খুঁজে তা হইলে আবার কী হবে কবে কেডা? এক মুক্তিযোদ্ধা থেকে আরেকজন, তার থেকে আরেকজন। হঠাৎ এক চ্যাংড়া সাংবাদিক আইসা পত্রিকায় নিউজ করব, কিছু বুঝার আগে দেখবি সবাই লাফায় আর কয় রাজাকারের বাচ্চার কল্লা চাই। তখন আমি যামু কই? আমার ইলেকশানের বারোটা বাজব।
মতি বলল, তার মানে হুজুর বইলছেন এই পোলাপানরে গেরাম থেকে বিদায় করন দরকার?
আজহার আলী হুঁকায় টান দিয়ে বলল, করতে পারলে ভালো। এই গেরামে ঘোঁট পাকানোর দরকার কী? অন্য গেরামে যাউক।
মতি কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, এইটা আর কঠিন কী। একটু ডর দেখাই, বাপ বাপ কইরা পালাইব।
খলিল বলল, ডর কেমনে দেখাইবি?
একটারে ধইরা এক রাইত আটকায়া রাখুম। বসে তা হইলেই পরের দিন বিদায়। আর জন্মে এই দেশে আসব না।
আজহার আলী জিজ্ঞেস করল, আটকায়া রাখবি কোনখানে?
মতি এক মুহূর্ত চিন্তা করল, তারপর বলল, বাড়িতে রাখা ঠিক হইব না। বড় গাঙে আপনার মহাজনী নৌকায়। কাকপক্ষীও টের পাইব না।
আজহার আলী কিছুক্ষণ হুঁকায় টান দিয়ে চিন্তা করল, তারপর বলল, বুদ্ধিটা খারাপ না। তয় কেউ যেন টের না পায় আমরা করাইছি। তাহলেই বিপদ।
কেউ টের পাইব না। খলিল জিজ্ঞেস করল, কিন্তু ধরবি কেমন করে? চিল্লাফাল্লা করব না?
মতি হে হে করে হাসল, বলল, হেইডা আমার উপর ছাইড়া দে। আল্লাহ আমারে বিশেষ কিছু দেয় নাই, খালি মগজে একটু বুদ্ধি দিচ্ছে।
খলিল বলল, তয় আল্লাহ তোরে কুনো ভালো বুদ্ধি দেয় নাই। খালি বদ বুদ্ধি দিছে।
মতি আবার হে হে করে হাসল। খলিলের কথাটা সে তার প্রশংসা হিসেবে ধরে নিয়েছে।
.
পাঁচজন ছেলে মেয়ে যখন হেঁটে হেঁটে এনজিও অফিসের গেস্টহাউজে হাজির হয়েছে তখন তারা কল্পনাও করতে পারে নাই এককালীন রাজাকার কমান্ডার তাদের একজনকে কিডন্যাপ করার পরিকল্পনা পাকা করে ফেলেছে।
০৮. যখন ভূতের গল্প
বাসায় যতবার মাছ রান্না করা হয় টিটন খাওয়ার সময় একবার হলেও নাক কুঁচকায়, যতবার সবজি খেতে হয় মিঠুন শুধু নাক কুঁচকায় না এমন ভান করে যে সেটা খেতে গিয়ে তার গলায় সবজি আটকে যাচ্ছে এবং দম বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্তু এই গেস্ট হাউজে তারা একবারও নাক কুঁচকালো না, গ্রামের মহিলার রান্না করা মাছের ঝোল এবং মিষ্টিকুমড়া ভাজি সবাই খুব সখ করে খেল।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে বাসার সবার সাথে টেলিফোনে কথা বলে, ঘুমের কাপড় পরে সবাই যখন গভীর রাতে ঘুমাতে গেল তখন আবিষ্কার করল মাত্র নয়টা বাজে। কেমন করে রাত নয়টার সময় নিশুতি রাত হয়ে যায় সেটা কেউ বুঝতে পারল না।
রিতু বলল, মাত্র নয়টা বাজে বিছানায় শুয়ে থেকে লাভ নেই। ঘুম আসবে না। তার থেকে আয়, বারান্দায় বসে গ্রাম দেখি।
সবাই এক কথায় রাজি। তারা হুটোপুটি করে বাইরে গিয়ে বারান্দায় বসল, ভালো করে লক্ষ্য করে নাই বলে দেখতে পেলো না তাদেরকে দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ শুট করে একটা গাছের আড়ালে সরে গেল।
বারান্দায় বসতেই প্রথমে তাদের চোখে পড়ল বিশাল একটা চাঁদ। রিতু বলল, দেখ দেখ, কী সুন্দর চাঁদ।
টিটন জিজ্ঞেস করল, কে বলতে পারবে এটা শুক্লপক্ষ না কৃষ্ণ পক্ষ?
মিঠুন জিজ্ঞেস করল, সেটা আবার কী জিনিস?
টিয়া বলল, চাঁদটা যখন বড় হতে থাকে সেটা হচ্ছে শুক্লপক্ষ আর যখন ছোট হতে থাকে সেটা হচ্ছে কৃষ্ণপক্ষ।
মিঠুন বলল, কী আজিব। চাঁদ আবার ছোট বড় হয়!
টিয়া বলল, এর মাঝে আবার আজিব কোনটা? তা ছাড়া শব্দটা মোটেও আজিব না। শব্দটা আজব।
একই কথা।
মোটেও একই কথা না।
রিতু বলল, হয়েছে এখন ঝগড়াঝাটি না। টিটন যেটা জিজ্ঞেস করেছে তার উত্তর দে, এটা কী শুক্লপক্ষ নাকী কৃষ্ণপক্ষ!
টিয়া বলল, পঞ্জিকা দেখে বলতে হবে। এমনি বলা যাবে না।
টিটন বলল, উঁহ পঞ্জিকা লাগে না। চাঁদ দেখলেই বোঝা যায়।
রিতু জিজ্ঞেস করল, কীভাবে?
দেখছ, চাঁদের একটা সাইড গোল, অন্য সাইডটা এবড়ো থেবড়ো?
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ দেখেছি।
গোল অংশটা যখন ডান দিকে তখন সেটা হচ্ছে শুক্লপক্ষ। গোল অংশটা যখন বাম দিকে তখন সেটা কৃষ্ণপক্ষ।
রিতু অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি! কী আশ্চর্য, আমি কখনো জানতাম না।
তিতু বলল, আপু তুমি কেমন করে জানবে? ঢাকায় কখনো চাঁদ উঠে না।
টিয়া বলল, উঠে কিন্তু কেউ দেখে না।