যেহেতু রিতু কিংবা টিয়া গুছিয়ে কথা বলতে পারে তাই সাধারণত তারাই প্রশ্নের উত্তর দেয় বলেন, জী আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।
কুন বাড়িতে আইছ?
জী আমরা এখানে কারো বাড়িতে আসি নাই।
তাইলে কী বেড়াতে?
আসলে আমরা একজনকে খুঁজতে আসছি। উনার নাম ইদরিস মিয়া।
ইদরিস? ইদরিস মিয়া?
জী, উনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
সাধারণত তখন মানুষগুলো বিভ্রান্ত হয়ে যায়। তারা শুধু একজন ইদরিসকে চিনে। পুরো নাম ইদরিস আলী, বয়স কম, দোকানে চাকরি করে। সে মুক্তিযোদ্ধা নয়। তারা যখন জিজ্ঞেস করে, ইদরিস মিয়াকে কেন খুঁজো?
আমরা উনার ইন্টারভিউ নিব।
ও। বলে মানুষগুলো এই কম বয়সী ছেলেমেয়েগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। রিতু তখন জিজ্ঞেস করে, আপনি কী জানেন মুক্তিযোদ্ধা ইদরিস মিয়াকে কোথায় পাওয়া যাবে?
মানুষগুলো তখন ঠিক করে উত্তর দিতে পারে না। ইদরিস মিয়া নামে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে তারা চেনে না। এই গ্রামে একজন মুক্তিযোদ্ধা চেয়ারম্যান ছিলেন, ইলেকশানের পরপর তাকে খুন করে ফেলেছে। তার নাম ছিল ফজলু। সবাই ডাকতো ফজলু চেয়ারম্যান। এছাড়া তার কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে চিনে না।
বাচ্চারা গ্রামের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত হেঁটে গেল। অনেকের সাথে তাদের কথা হলো, সবাইকেই তারা ইদরিস মিয়ার কথা জিজ্ঞেস করল কিন্তু কেউই তার খোঁজ দিতে পারল না। এক জায়গায় একটা গাছের নিচে তারা একটা ছোট দোকান পেয়ে গেল। দোকানের সামনে বাঁশ দিয়ে মাচার মতো করে বসার জায়গা করা হয়েছে এবং দোকানের সামনে একটা চুলার মাঝে তোবড়ানো একটা কেতলিতে পানি গরম হচ্ছে। কেউ চা খেতে চাইলে কেতলির গরম পানি দিয়ে চা তৈরি করে দেওয়া হয়। চায়ের এই আয়োজন দেখে সবার চা খাওয়ার ইচ্ছা হলো। তখন বাঁশের মাচার মাঝে বসে তারা চায়ের অর্ডার দিলো। দোকানি তাদের নানা খোঁজ খবর দিতে দিতে তাদের জন্য চা বানিয়ে দিল। পায়েশের মতো বেশি করে দুধ এবং চিনি দিয়ে তৈরি চা, খেয়ে তারা মুগ্ধ হয়ে গেল।
এই দোকানির কাছে তারা কিছু মূল্যবান খবর পেল। সংগ্রামের সময় এইখানে নদীর তীরে পাকিস্তান মিলিটারির ক্যাম্প ছিল এবং তখন অনেক যুদ্ধ হয়েছে। অনেকদিন আগের ঘটনা তাই কেউ বিশেষ কিছু জানে না। দোকানি কিছু বয়স্ক মানুষের নাম বলল, যারা সংগ্রামের সময় ছিল এবং তারা হয়তো খবর দিতে পারবে। টিয়া তার নোট বইটা বের করে তাদের নাম লিখে নিল।
বাচ্চাদের সাথে আরো কয়েকজন বাঁশের মাচায় বসে চা খাচ্ছিল তারা উঠে যাবার পর দোকানি এদিক সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে তাদেরকে আরো একটা খবর দিল। মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বেশি খবর দিতে পারবে যে মানুষটা তার নাম আজহার আলী। সে সংগ্রামের সময় রাজাকার কমান্ডার ছিল। এতদিন চুপচাপ ছিল, ২০০০ সালের ইলেকশানের পর তার তেজ বেড়েছে, কয়েকদিন থেকে সে হম্বি তম্বি করে বেড়ায়। তবে তাকে না ঘাটানোই ভালো।
বাচ্চারা যখন ফিরে আসছিল তখন নিজেদের ভেতর কথা বলে নিজেরাই ঠিক করে নিল যে তারা রাজাকার আজহার আলীকে ঘাটাবে না। এই দেশে যেহেতু আলবদর কমান্ডার মন্ত্রী হয়ে গেছে রাজাকার কমান্ডার একটু হম্বিতম্বি করতেই পারে।
তবে বাচ্চারা জানতো না তারা যে এই গ্রামে এসে ইদরিস মিয়া নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই খবরটা এর মাঝে আজহার আলীর কাছে পৌঁছে গেছে। রাজাকার কমান্ডার আজহার আলী খবরটা পেয়ে খুবই বিরক্ত হয়েছে এবং তাদের মোটামুটি নিরিবিলি গ্রামে পোলাপানদের এই উৎপাত কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটা নিয়ে তার বিশ্বস্ত দুইজন মানুষের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে।
বাচ্চারা যখন হেঁটে হেঁটে তাদের এনজিও গেস্ট হাউজে ফিরে আসছে, ঠিক তখন আজহার আলী তার বাড়ির উঠানে একটা জলচৌকিতে বসে তার দুইজন সাগরেদের সাথে কথা বলছে। সাগরেদ দুইজনের নাম মতি এবং খলিল। তাদের মাঝে যে কথাবার্তা হয়েছে সেগুলো এরকম :
আজহার আলী তার হুঁকোর নলে মুখ দিয়ে গুড়ুক গুড়ুক করে টান দিয়ে বলল, ঢাকা শহর থেকে পোলাপান এসে নাকী মুক্তিযোদ্ধা তালাশ করে? ব্যাপারটা কী সত্যি?
মতি বলল, জি হুজুর সত্যি?
কারণটা কী? এতদিন পর পোলাপানদের মুক্তিযোদ্ধা তালাশ করার দরকার কী?
হুজুর ইলেকশানে আমরা জেতার পর শুরু হইছে। যেইখানে যাই সেইখানেই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, মহা যন্ত্রণা! কেউ তো চিন্তা করে নাই। আমরা ইলেকশানে জিতে ক্ষমতায় আসমু সেইটা হচ্ছে তাদের জ্বালা। সবাই খালি তড়পায়।
হুঁকোয় আরো দুইটা টান দিয়ে আজহার আলী বলল, তড়পাইতে চায় তড়পাউক। তাদের না করছে কেডা? তয় আমাগো গেরামে কেন? তড়পানোর জায়গা ঢাকা শহর। এই গ্রামে ঝামেলা পাকায় কেন?
মতি বলে, যেখানেই সুযোগ পায় সেইখানেই একটা ফাল পাড়ে।
খলিল এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এখন বলল, হুজুর এই পোলাপান ঢাকা থাকে, এই গাও গেরামে বেশিদিন থাকব না। কাইল হোক পরশু হোক চইলা যাইব। দুই চাইরদিন একটা বেহুদা মুক্তিযোদ্ধারে খুঁজলে সমস্যা কী? খুঁজুক।
আজহার আলী বলল, বুঝস না? সংগ্রামের কথা হইল নেশার মতন! একজন সংগ্রামের কথা কইলে হলের মনে পড়ে। তখন হপ্পলেই সংগ্রামের কথা কয়। তখন একাত্তর সালের কথা মনে পড়ে। পাকিস্তানি মিলিটারির কথা মনে পড়ে। আমাগো কথা মনে পড়ে।