টিয়া একটু বিপদের লক্ষণ দেখে তাড়াতাড়ি রাহেলা খাতুনের কাছে চলে এল। অন্যরাও টের পেলো এখন এটাই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা তাই তারাও গুটিগুটি তাদের নানি কিংবা দাদি রাহেলা খাতুনের আশে পাশে জায়গা নিল।
মাসুদ বলল, ঠিক আছে মা, তোমাকে যেতে হবে না। আমরা ব্যবস্থা করছি। এক দুইদিন সময় দিতে হবে। আমি একজনকে এদের সাথে পাঠাব দেখে শুনে রাখবে। তবে- বলে মাসুদ থেমে গেল।
রাহেলা খাতুন বলল, তবে কী?
তবে ওদেরকে বল এরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে কিন্তু জীবনেও যেন অনশন না করে।
রাহেলা কিছু বলার আগেই বাচ্চারা চিৎকার করে বলল, করব না। করব না। আর করব না।
মনে থাকে যেন।
রাহেলা খাতুন বলল, আয় এখন সবাই। কী খাবি বল?
মিঠুনের মা রাণী বলল, জিজ্ঞেস করবেন না মা, তাহলে বলবে পিজা না হলে ফ্রায়েড চিকেন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
.
বাচ্চারা খেতে খেতে টের পেল সারাদিন অনশন করলে খেতে যে কী ভালো লাগে সেটা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।
০৭. যখন গ্রামে হাজির
দুই দিন পর সকাল বেলা পাঁচ ভাই বোনকে সেই উত্তর বঙ্গের এক প্রত্যন্ত এলাকার মেথিকান্দা গ্রামের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে যেতে দেখা গেল, তাদের পিছনে পিছনে মাঝবয়সী একজন মানুষ। মানুষটির নাম মোহম্মদ ইব্রাহীম, সবাই তাকে ইব্রাহীম চাচা ডাকে। রাহেলা খাতুনের বড় ছেলে মাসুদ ইব্রাহীম নামের মানুষটাকে এই পাঁচজনের দায়িত্ব দিয়েছে। মাসুদ সার্টিফিকেট দিয়েছে মানুষটি খুবই কাজের মানুষ এবং দেখা গিয়েছে সে আসলেই খুবই কাজের মানুষ। সে মেথিকান্দা গ্রামের কাছে একটা এনজিও অফিস খুঁজে তাদের গেস্ট হাউজটা বের করেছে। সেই গেস্টহাউজ এক সপ্তাহের জন্য ভাড়া নিয়েছে, শুধু তাই নয় গ্রামের একজন মহিলাকে খুঁজে বের করে তাকে প্রত্যেক দিন তিনবেলা রান্না করার দায়িত্ব দিয়েছে।
তারা গত রাত্রে এখানে পৌচেছে, রাত্রে ঘুমিয়ে সকালে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা করেছে। তারপর মেথিকান্দা গ্রামটা দেখতে বের হয়েছে। ইব্রাহীম চাচা মানুষটা খুবই কাজের সেটা সবাই বুঝতে পেরেছে তার সাথে সাথে তারা তার সবচেয়ে বড় সমস্যাটাও টের পেয়েছে। সেটা হচ্ছে মানুষটা কোনো কথা বলে না। একেবারেই কথা বলে না-তার ফলে অবশ্য একটা লাভ হয়েছে যখন সে কোনো কথা বলে সেটা হয় লক্ষ টাকা দামের কথা।
যে রকম পাঁচজন গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে একটা গরু দেখতে পেল। টিটন যখন নাদুস নুদুস গরুটা একটু কাছ থেকে দেখতে যাচ্ছে তখন ইব্রাহীম চাচা বলল, এরকম লাল শার্টটা পরে এত কাছে যাওয়া ঠিক না।
টিটনের টি-শার্টটা আসলেই টকটকে লাল এবং গরুরা লাল রং দেখে এরকম উত্তেজিত হয়ে যায় কে জানতো? ইব্রাহীম চাচা তার কথাটা শেষ করার আগেই নাদুস নুদুস গরুটা মাথা নিচু করে শিং উঁচিয়ে টিটনকে ধাওয়া করে এল- টিটন জান নিয়ে কোনো মতে পালিয়ে এসেছে, ভাগ্যিস গরুটা দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল তা না হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত।
ইব্রাহীম চাচা একটু পরে আবার একটা লক্ষ টাকা দামের কথা তিতুকে লক্ষ্য করে বলল, তোমার পায়ের গোছাতে কালো মতন জিনিসটা একটা জোক।
তিতু না হয়ে এটা রিতু হলে সে তখনই হার্টফেল করে ফেলত, কিন্তু তিতু বেশি ব্যস্ত হলো না। সবাই মিলে তখন জোকটাকে টেনে আলাদা করল। জোঁককে ধরে টানলে সেটা যে রাবার ব্যান্ডের মতো লম্বা হয় সেটাও তারা আজকে প্রথম আবিষ্কার করল।
পাঁচজন মিলে হাঁটতে হাঁটতে যখন বড় একটা বটগাছ পেয়েছে এবং এই বিশাল বটগাছের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে আহা উঁহু করছে তখন ইব্রাহীম চাচা ঠাণ্ডা গলায় বলল, এই গাছের নিচে থেকো না। অনেক পাখি। মাথায় ইয়ে করে দেবে।
কথা শেষ করার আগেই কোনো একটা ফাজিল পাখি রিতুর মাথায় ইয়ে করে দিল! কী কেলেঙ্কারি! ঘেন্নায় তিতু প্রায় বমি করে দেয় সেই অবস্থা! তবে ইব্রাহীম চাচা তার সবচেয়ে মূল্যবান কথাটা বলল মিঠুনকে লক্ষ্য করে। গ্রামের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা পুকুর পাড়ে পৌঁছালো এবং সেই পুকুর পাড়ে বেশ কিছু রাজহাঁস দাঁড়িয়ে নিজেদের ভেতর আড্ডা মারছিল। মিঠুন বলল, দেখেছ কী সুন্দর রাজহাঁস?
আসলেই রাজহাঁস দেখতে খুব সুন্দর তাদের বিশাল লম্বা গলা নাড়িয়ে নাড়িয়ে তারা এদিক সেদিক দেখে। মিঠুন যখন রাজহাঁস গুলোকে একটু আদর করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল তখন ইব্রাহীম চাচা বলল, রাজহাঁস খুব ডেঞ্জারাস।
এত সুন্দর লক্ষ্মী রাজহাঁস কেমন করে ডেঞ্জারাস হতে পারে মিঠুন বুঝতেই পারল না এবং সে ইব্রাহীমের কথা বিশ্বাস না করে এগিয়ে গেল। তখন হঠাৎ করে রাজহাঁসগুলো তাদের লম্বা লম্বা গলাকে সাপের ফণার মতো নাড়িয়ে ফোঁস ফোঁস করে মিঠুনকে আক্রমণ করল। এত যে দুষ্ট মিঠুন সে কোনো মতে জান নিয়ে পালানোর চেষ্টা করল এবং দৌড়ে একটা খালের মাঝে লাফিয়ে পড়ে জান বাঁচালো। রাজহাঁসগুলো খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে মিঠুনের উদ্দেশ্যে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল।
এরপর থেকে পাঁচজনের এই ছোট দলটা ইব্রাহীমের কথাগুলোকে খুব গুরুত্ব দিয়ে শুনতে থাকল।
বাচ্চাগুলো সারা জীবন মোটামুটি শহরেই বড় হয়েছে। তাই তাদের জন্য গ্রামটি খুবই বিচিত্র একটা অভিজ্ঞতা। তারা মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। এবং একবারও পিছন থেকে একটা বড় ট্রাক বিকট হর্ন দিয়ে ছুটে আসছে না। গ্রামের মানুষেরা আস্তে আস্তে হেঁটে কাজে যাচ্ছে এবং প্রায় সবাই তাদের থামিয়ে তাদের সাথে কথা বলছে। কথাবার্তাগুলো হচ্ছে এরকম: একজন হয়তো বড় বড় কয়েকটা গরু নিয়ে যাচ্ছে সে তার গরুগুলোকে আপন মনে হেঁটে যেতে দিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমরা কোনখান থেকে আইছ?