মিলি বলল, সবাই কতক্ষণ না খেয়ে থাকবে?
রিতু বলল, কতক্ষণ আর থাকবে? দেখো একটু পরেই যখন খিদে লাগবে অনশন ভেঙ্গে ফেলবে।
.
কিন্তু কেউ অনশন ভাঙ্গলো না। নাস্তার সময় পার হয়ে দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেল, সবাই চুপচাপ বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। রিতু উপর নিচ করতে লাগল। সে নিজেও না খেয়ে আছে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে কিন্তু অনশন বলে কথা।
তাদের আব্ব আম্মুরা প্রথমে বোঝালেন, তারপর আদর করলেন, তারপর রাগ হলেন, তারপর আবার আদর করলেন। তারপর চেঁচামেচি করলেন তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই কান্না কান্না হয়ে গেলেন।
রাহেলা খাতুন সন্ধেবেলা খবর পেলেন, তারপর যা একটা কাণ্ড শুরু হলো সেটা বলার মতো না। সাথে সাথে উপরে ছুটে গেলেন, মিঠুন আর তিতুকে দেখলেন, তাদের সব কথা শুনলেন, তাদের আদর করলেন, তারপর তাদের নিয়ে নিচে নেমে এলেন টিটন আর টিয়ার কাছে। তাদের দেখলেন তারপর আদর করে সবাইকে একেবারে নিচে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন। তারপর রিয়াকে পাঠালেন তার সব ছেলে মেয়ে ছেলের বউ মেয়ের– জামাই সবাইকে ডেকে আনতে। রিয়া কিছুক্ষণের মাঝে সবাইকে ডেকে নিয়ে এল।
রাহেলা খাতুন তার চেয়ারটিতে বসে আছেন অন্যেরা কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে রইল। রাহেলা খাতুন থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সব নাতি নাতনিরা অনশন করছে ব্যাপারটা কী?
মিঠুন চিঁ চিঁ করে বলল, আমরণ অনশন।
আমরণের দরকার নাই। শুধু অনশনই যথেষ্ট। তারপর অন্যদের জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা কী? বাসায় এত বড় একটা ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে আমি জানি না।
রাহেলা খাতুনের ছেলে মেয়ে এবং বউ জামাইয়েরা ইতস্তত করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত মাসুদ বলল, না মা, আমরা আসলে বুঝি নাই এরা এরকম পাগলামি শুরু করবে।
পাগলামো? রাহেলা খাতুন কেমন যেন রেগে উঠলেন। বললেন, এই বাসায় পাগলামো নিয়ে এর আগে তো কোনো সমস্যা হয় নাই। বাসার নাম দিয়ে রেখেছিস বকিল্লারে খা। এইটা পাগলামো না? দুইটা ছাগল ঘুরে বেড়ায় একটা সবুজ আরেকটা লাল এইটা পাগলামো না? বিড়ালকে রং করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বানিয়েছিস এইটা পাগলামো না? তাহলে এদের পাগলামোতে তোদের সমস্যাটা কী?
মিলি মিন মিন করে বলল, শুধু পাগলামো তো না, একটু রিস্কি। একলা কোন গ্রামে গিয়ে থাকবে বিপদ আপদ হতে পারে।
রাহেলা খাতুন ধমক দিয়ে বললেন, বিপদ আপদ যেন না হয় সেই ব্যবস্থা করবি।
মতিন মাথা চুলকে বলল, না, মানে, ইয়ে-
বাচ্চাগুলো একটা মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করার জন্য একটা গ্রামে যেতে চায় আর তোরা সেই জন্যে সাহায্য করবি না? তোরা জানিস তোদের বাপ যে মুক্তিযোদ্ধা ছিল? যুদ্ধ করতে গিয়ে মানুষটা যে মরেই গেছে সেটা জানিস না ভুলে গেছিস?
সব ছেলে মেয়ে এক সাথে কথা বলে উঠে, কী বলছ মা, তুমি এটা কী বলছ? বাবার কথা ভুলে যাব-
নাকি পুরা দেশ রাজাকারের দেশ হয়ে গেছে সেই জন্যে এখন সেইটা স্বীকার করতে ভয় পাস?
মিঠুন চি চি করে বলল, রাজাকারের চামড়া, তুলে নিব আমরা।
মতিন বলল, মা তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না। কোন গ্রামে যাবে চিনি জানি না, সময়টাও ভালো না। কোথায় থাকবে, কোথায় ঘুমাবে, কীভাবে যাবে কীভাবে আসবে, মানে পুরা ব্যাপারটার তো একটা প্ল্যানিং দরকার।
রাহেলা খাতুন বললেন, যদি প্ল্যানিং নাই তাহলে প্ল্যানিং করবি। দরকার হলে সাথে যাবি। নিজে যেতে না পারলে একটা ব্যবস্থা করে দিবি। তোদের এখন অভাবটা কীসের? আছে কোনো অভাব?
না, তা নাই।
তাহলে?
তারপরেও মানে হুট করে বললেই তো সব হয়ে যায় না- কাউকে করতে হয়।
রাহেলা খাতুন হঠাৎ রেগে উঠলেন, ঠিক আছে তোদের কিছু করতে হবে না। আমি করব। আমি ওদের গ্রামে নিয়ে যাব, ওদের সাথে থাকব। তারপর তাদের নাতি নাতনির দিকে তাকিয়ে বললেন, নে তোরা তোদের ব্যাগ রেডি কর। আমি নিয়ে যাব তোদের। তার আগে খেয়ে নে অনশন ভাঙ।
বাচ্চারা অন্য সময় হলে আনন্দে চিৎকার করত কিন্তু এখন যেহেতু রাগারাগি হচ্ছে মান অভিমান হচ্ছে, বাসার বড় মানুষেরা কথা বলছে তাই কেউ কোনো কথা বলল না, একজন আরেক জনের মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল।
রাহেলা খাতুনের বড় ছেলে বলল, তুমি নিয়ে যাবে কেন মা?
তোরা নিয়ে যাবি না সেই জন্যে আমি নিয়ে যাব। কী ভাবছিস, আমি পারব না?
না না, পারবে না কেন। তুমি চাইলে অবশ্যই পারবে।
হ্যাঁ, সেইটা মনে রাখিস। আমি চাইলে সব পারি। আমি একা তোদের চারজনকে বড় করেছি। খেয়ে না খেয়ে বড় করেছি। আর তোরা বড় হয়ে আমার নাতি নাতনিগুলোকে কষ্ট দিবি সেটা হবে না। সারাদিন থেকে না খেয়ে আছে, কী আশ্চর্য!
মতিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মা, তুমি যখন আমাদের বড় করেছ আমরা খুবই ভালো ছেলে মেয়ে ছিলাম। তারপর নিজেদের ছেলে মেয়েগুলোকে দেখিয়ে বলল, আর এরা কী ভয়ংকর দুষ্টু তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। এই অনশনের ব্যাপারটা দেখো, সারা পৃথিবীতে তুমি এই বয়সী কোনো বাচ্চা পাবে যে এইভাবে তাদের বাপ মাকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারবে?
টিয়া নিচু গলায় বলল, এইটা তো ব্ল্যাকমেইল না, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল।
সীমা বলল, মা দেখেছেন? আপনি দেখেছেন? কতো বড় ফাজিল দেখেছেন? আমাদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শেখায়?