মিঠুনের আম্মু বলল, মাথাটা খারাপ হয়েছে?
তখন বাকি থাকল শুধু ছোট চাচা কিংবা ছোট মামা তাকে পেতেই অনেক সময় লাগল। যখন তাকে পাওয়া গেল, তখন সে খুবই মনোযাগ দিয়ে একটা মোটা ইংরেজি বই পড়ছে। সবকিছু শুনে সে বলল, ও আচ্ছা, ভেরি গুড। ভেরি গুড।
তারপর আবার বইটা পড়তেই শুরু করল। যার মানে তারা কী বলছে সেটা ছোট চাচা কিংবা ছোট মামা ভালো করে শুনে নাই পর্যন্ত। অন্য সময় হলে যতক্ষণ ঠিক করে না শুনছে ততক্ষণ চেষ্টা করে তারা শুনিয়ে ছাড়তো, কিন্তু আজকে তাদের এতটাই মন খারাপ হলো যে তাদের সেটা করারও ইচ্ছা করল না।
পাঁচজন তাদের গলা থেকে লেমিনেটেড করা ভলাটিয়ার কার্ড খুলে মুখ কালো করে বসে রইল।
০৬. যখন একটা কাণ্ড
সকাল বেলা কেউ টের পায় নাই দিনটা এই বাসার ইতিহাসের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ একটা দিন হয়ে যাবে! দিনটা শুরু হয়েছে খুবই শান্তভাবে। সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠেছে, হাত মুখ ধুয়েছে তারপর নাস্তা করতে বসেছে। মতিনের সকাল বেলা একটা জরুরি অপারেশন করতে হবে সে তাড়াতাড়ি নাস্তা করতে করতে মিঠুনকে ডাকল, এই মিঠুন। তাড়াতাড়ি আয় নাস্তা করবি।
মিঠুন ধীরে সুস্থে এসে গম্ভীর মুখে বলল, আমি নাস্তা করব না।
মতিন কথাটা ভালো করে বুঝল না। বলল, কী করবি না?
নাস্তা করব না।
মতিন ডিমপোচটা মুখে দিয়ে বলল, নাস্তা করবি না মানে?
নাস্তা করব না মানে, নাস্তা করব না।
ততক্ষণে মিঠুনের আম্মু রাণীও ডাইনিং টেবিলে এসেছে, জিজ্ঞেস করল, কী হচ্ছে এখানে?
মতিন পানি খেয়ে কেটলি থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, তোমার ছেলে বলছে সে নাস্তা করবে না।
নাস্তা করবে না তো কী করবে?
মতিন বলল, আমি জানি না। তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো।
রাণী মিঠুনকে জিজ্ঞেস করল, মিঠুন, তুই নাস্তা করবি না? শরীর খারাপ?
না শরীর খারাপ না।
তাহলে নাস্তা করবি না কেন?
আমি অনশন করছি।
মতিন তার চায়ে বিষম খেলো। রাণী জিজ্ঞেস করল, কী করছিস?
অনশন। তারপর অনশনের গুরুত্বটা বোঝানোর জন্য হেঁটে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল।
মতিন চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বলল, তুই অনশন করছিস?
হ্যাঁ।
কেন?
কারো দাবি মেনে না নিলে সবসময় অনশন করে।
তোর দাবি মানা হয় নাই?
না।
কোন দাবি মানা হয় নাই?
আমরা মুক্তিযোদ্ধার ইন্টারভিউ নিতে চাচ্ছিলাম তোমরা যেতে দাও নাই।
মতিন কিছুক্ষণ হা করে মিঠুনের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু হঠাৎ হি হি করে হেসে উঠল, তারপর বলল, তোমার ছেলেকে আমি যতই দেখি ততই অবাক হই।
মতিন বলল, আমার ছেলে বল না। অর্ধেক ক্রমোজম তোমার।
রাণী বলল, আই ডি এফ করার সময় মনে হয় উল্টাপাল্টা হয়ে গিয়েছিল।
মিঠুন মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। মতিন বলল, কতক্ষণ অনশন করবি?
এটা আমরণ অনশন।
আমরণ?
মিঠুন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ দাবি মানা না হলে আমরণ।
মতিন তার ঘড়ি দেখল, তারপর রাণীকে বলল, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি দেখো কী করতে পার।
রাণী বলল, দেখছি। তারপর নিজের প্লেটে টোস্ট নিতে নিতে গলার স্বর নরম করে বলল, আয় একটু খেয়ে নে। তারপর ভালো করে অনশন করতে পারবি।
মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, কেউ কখনো খেয়ে অনশন করে না।
ঠিক আছে দুধটা খেয়ে নে। দুধ খেলে অনশন ভাঙ্গে না। অনশন করলে লিকুইড খাওয়া যায়।
শুধু পানি খাওয়া যায়। আমি জানি। মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, আমার যখন পানি খাওয়ার ইচ্ছা করবে তখন পানি খাব। আর কিছু খাব না। অনশন।
কথা শেষ করে সে সত্যি সত্যি হেঁটে নিজের রুমে চলে গেল।
রাণী তার প্লেটে দুই টুকরো টোস্ট নিয়ে বসে রইল। তার এখন রেগে উঠার কথা কিন্তু রাগতে পারছে না।
.
রিতুকে মিলি ঘুম থেকে ডেকে তুলল, বলল, এই রিতু, ওঠ।
রিতু চোখ মুছতে মুছতে বলল, কী হয়েছে?
রাণী একটু আগে এসেছিল, বলে গেছে মিঠুন নাকি অনশন করছে। তার কোনো কথা শুনছে না। আমাকে বলেছে তোকে পাঠাতে। তুই গিয়ে একটু বুঝিয়ে বললে মনে হয় খাবে।
কিসের জন্য অনশন- জিজ্ঞেস করতে গিয়ে রিতু থেমে গেল। হঠাৎ করে সে বুঝে গেল মিঠুন কেন অনশন করছে, এবং সাথে সাথে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। ঠিক কী কারণ জানা নেই মিঠুন অনশন করছে জেনে তার মনে হলো সে ঠিকই করছে। তাদের সবারই অনশন করা উচিৎ।
রিতু বিছানা থেকে উঠে বসল। আজকে ছুটির দিন, ছুটির দিনে সে একটু দেরি করে ঘুমায়। কিন্তু এরকম একটা ঘটনার পর সে নিশ্চয়ই আর ঘুমাতে পারে না।
তিতু পাশেই ছিল রিতু বলল, চল তিতু মিঠুনকে দেখে আসি।
তিতু বলল, চল।
দুজন উপর তলায় গিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। প্রথমে রাণী বিষয়টাকে হালকা ভাবে নিয়েছিল কিন্তু আস্তে আস্তে তার মেজাজ গরম হতে শুরু করেছে। রিতুকে ঢুকতে দেখে বলল, রিতু দেখ দেখি মিঠুনকে বোঝাতে পারিস কিনা। সকালে উঠেই ঢং শুরু করেছে, অনশন!
রিতু মিঠুনের রুমে ঢুকল। সে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, একটা চাদর দিয়ে বুক পর্যন্ত ঢাকা। রিতু জিজ্ঞেস করল, মিঠুন, কী করছিস?
মিঠুন গম্ভীর গলায় বলল, আমরণ অনশন।
আমরণ?
হ্যাঁ।
মামি কিন্তু রেগে যাচ্ছে।
রাগুক।
কতক্ষণ না খেয়ে থাকবি।
যতক্ষণ দাবি মানা না হবে।
সত্যি?
খোদার কসম।
রিতু বলল, মামি বলেছে তোকে বোঝাতে।
কেউ আমাকে বোঝাতে পারবে না। যেই আমাকে বোঝাতে আসবে সেই হচ্ছে রাজাকার। রাজাকারের চামড়া তুলে নিব আমরা।