বাচ্চারা সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। রাহেলা খাতুনের জন্মদিন ততদিনে পার হয়ে যাবে। তারা ঠিক করে রেখেছিল এটা হবে নানির জন্মদিনের ওপরে।
ছেলেমেয়েদের মুখ দেখে মুশতাক আহমেদ বুঝতে পারলেন, জিজ্ঞেস করলেন, ততদিনে তোমার দাদির জন্মদিন চলে আসবে?
জি, জি- সবাই জোরে জোরে মাথা নাড়ল।
রিতু বলল, দাদির জন্মদিন সামনের মাসের একুশ তারিখ। আমরা এর আগে বের করতে চাচ্ছিলাম।
মুশতাক আহমেদ চেয়ারে হেলান দিয়ে দাড়ির ভেতর আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে চিন্তা করতে লাগলেন। ঠিক তখন টিয়া বলল, রিতু আপু?
কী হলো?
আমরা কী ঐ জায়গাতে গিয়ে ঐ মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করতে পারি না?
রিতু অবাক হয়ে বলল, আমরা?
হ্যাঁ। আমরা।
মিঠুন হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ইয়েস।
টিটন বলল, টিয়া ঠিকই বলেছে, আমরা ঐ গ্রামে গিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলব।
শুধু তিতু লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, দিবে না! আমাদের যেতে দিবে না।
টিয়া বলল, আমরা স্যারের ভলান্টিয়ার হয়ে যাব। বাসায় গিয়ে বলব, আমরা মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণা করব।
রিতু চুপ করে চিন্তা করল, তারপর বলল, সেটা একটা আইডিয়া হতে পারে। তারপর মুশতাক আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, আমরা কী ভলান্টিয়ার হতে পারি?
মুশতাক আহমেদ বললেন, যে কেউ ভলান্টিয়ার হতে পারে। তোমরা বয়সে একটু ছোট, কিন্তু কে বলেছে বয়স কমে হলে মুক্তিযুদ্ধের ভলান্টিয়ার হতে পারবে না। কম বয়সে যদি মুক্তিযুদ্ধ করা যায় তাহলে ভলান্টিয়ারও হওয়া যায়।
টিয়া বলল, আমরা শুধু স্যারের কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে যাব। স্যার লিখে দিবেন আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার ভলান্টিয়ার।
মুশতাক আহমেদের ঘরে যে মেয়েটি তাদের দরজা খুলে দিয়েছিল, সে বলল, স্যার যদি রাজি থাকেন তাহলে আমি তোমাদের ভলান্টিয়ার কার্ড তৈরি করে দিতে পারি।
সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। মুশতাক আহমেদ হেসে বললেন, অবশ্যি তৈরি করে দাও। লেমিনেটিং করে দিও যেন দরকার হলে গলায় ঝুলিয়ে ঘুরতে পারে। সবাই দেখুক আমাদের কত ছোট ছোট ভলান্টিয়ার আছে।
বাসায় ফিরে আসার আগে টিয়া তার বইটিতে মুশতাক আহমেদের অটোগ্রাফ নিয়ে এল।
.
সেদিন রাত্রি বেলাতেই পাঁচ ভাইবোনের দলটি তাদের গলায় ভলান্টিয়ারের লেমিনেটিং করা কার্ড নিয়ে তাদের বাবা মা চাচা চাচি মামা মামির কাছে। যাওয়া শুরু করল।
প্রথমে গেল রাহেলা খাতুনের সবচেয়ে বড় ছেলে মাসুদের কাছে, বাচ্চাদের এই বড় চাচা কিংবা বড় মামাকে তাদের নানা ধরনের আবদার খুব সহজে মেনে নেন। সেইজন্যে তাকে নিয়ে তারা শুরু করল। কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে কোনো এক মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করে তার ইন্টারভিউ নেওয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব পেয়েছে বিষয়টা খুব ভালো করে বোঝানোর পর তারা এক সপ্তাহের জন্যে সেই গ্রামে থাকার অনুমতি চাইল।
কারো বাবা, কারো বড় চাচা এবং কারো বড় মামা মাসুদ সব কিছু শুনে গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, কাজটি খুবই মহৎ সন্দেহ নাই, কিন্তু এটি তোদের উপযোগী কাজ নয়। তাছাড়া একজন মানুষের ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য পাঁচজন যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তোরা কী প্রশ্ন করতে চাস একটা কাগজে লিখে দে, আমি অফিস থেকে একজনকে পাঠিয়ে দেই, সে উত্তরগুলো লিখে আনবে।
টিটন বলল, কিন্তু আব্ব কিন্তু কিন্তু
তারপর কী বলবে বুঝতে পারল না। টিয়া বলল, আগে সেই মুক্তিযোদ্ধাটাকে খুঁজে বের করতে হবে।
একটা গ্রামে কাউকে চিনিস না জানিস না সেইখানে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তোরা খুঁজে বের করবি? তোরা?
খুবই সহজ একটা বাক্য কিন্তু বড় চাচা এমনভাবে সেটা বলল যে শুনে মনে হলো আসলেই এটা বুঝি খুবই অবাস্তব এবং হাস্যকর একটা কাজ।
বড় চাচা মাসুদের সাথে কথা বলার সময় বড় চাচি সীমা এসে এক সাথে সবাইকে দেখে বলল, কী হচ্ছে এখানে? কীসের ষড়যন্ত্র?
টিয়া মুখ গম্ভীর করে বলল, মোটেই ষড়যন্ত্র না আম্মু। আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করতে চাচ্ছি।
টিয়ার মুখ থেকে সবকিছু শুনে সীমা ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, তোরা একা একা গ্রামে গিয়ে থাকবি? রাত্রে শেয়ালের ডাক শুনে যখন ভয়ে চিৎকার করতে থাকবি, তখন তোদের দেখে রাখবে কে?
টিটন গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা মোটেও শেয়ালের ডাক শুনে ভয়ে চিৎকার করব না।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা কত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার তবুও বড় চাচি পুরো ব্যাপারটা নিয়ে খিল খিল করে হাসতে থাকলেন, কোনো গুরুত্বই দিলেন না।
বড় চাচা এবং বড় চাচির সাথে কথা বলাটা পুরোপুরি বৃথা যাওয়ার পর তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। তারপরেও তারা অন্যদের সাথে একটু চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হলো না। রিতু তিতুর আম্মু মিলা বলল, এর চাইতে আমি প্লেনের টিকেটের ভাড়া দিই, ঐ মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে নিয়ে আয়। বাসায় থাকবে, যত খুশি ইন্টারভিউ নিতে পারবি।
রিতু তিতুর আব্ব বলল, আমি খুবই হতাশ হলাম যে তোরা ভাবিস আমাদের কোনো দায়িত্ববোধ নেই, আমরা তোদেরকে এক সপ্তাহের জন্যে এভাবে একটা গ্রামে একা একা ছেড়ে দেব।
এরপর আর কারো সাথে কথা বলার আর কোনো উৎসাহ থাকার কথা না। তারপরও তারা মিঠুনের আব্ব আম্মুর সাথে একটু চেষ্টা করল। দুইজনেই ডাক্তার, দুইজনই ব্যস্ত তারপরও তারা একটা গ্রামে এক সপ্তাহ থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করে তার ইন্টারভিউ নেওয়ার বিষয়টা শুনল। মিঠুনের আব্দু গম্ভীর হয়ে বলল, যখন তোরা আরো বড় হবি, নিজের দায়িত্ব নিজেরা নিতে পারবি তখন দেখা যাবে।