বাসার সামনে এই বিদঘুটে গর্তটাকে কী কাজে লাগানো যায় সেটা নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছিল তখন রাহেলা খাতুন তার নাতি নাতনিদের বলেছিলেন, আমি মরে গেলে তোরা এই গর্তে আমাকে পুতে ফেলিস।
রাহেলা খাতুন হাল্কা পাতলা হাসি খুশি মানুষ তার শরীরে কোনো রোগ বালাই নেই। তার নাতি নাতনিরা তাকে অসম্ভব পছন্দ করে, রাহেলা খাতুন কোনো একদিন মরে যাবেন সেটা তারা কল্পনাও করতে পারে না। তারপরেও তারা গজ ফুট ফিতে দিয়ে তাকে মেপে দেখে বের করেছে যে রাহেলা খাতুন যদি তার পাগুলো ভাঁজ করে উত্তর পূর্ব থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে কোনাকোনি ভাবে কবরস্থ হতে রাজি থাকেন তাহলে তাকে বাসার পাশে এই গর্তে পুতে ফেলা সম্ভব। রাহেলা খাতুন একশর্তে হাসিমুখে পা ভাঁজ করে কোনাকুনি ভাবে কবরস্থ হতে রাজি হয়েছেন, শর্তটি হলো তার কবরের ভেতর একটা টিউব লাইট লাগিয়ে দিতে হবে। অন্ধকার কবরের কথা চিন্তা করলেই তার নাকী ভয়ে বুক ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। রাহেলা খাতুনের নাতি নাতনিরা বলেছে শুধু টিউব লাইট নয় তারা চার্জার সহ একটা মোবাইল টেলিফোনও কবরের ভিতরে দিয়ে দেবে। রাহেলা খাতুন ইচ্ছে করলেই কবরের ভেতর থেকে তার নাতি নাতনিদের মিসকল দিতে পারবেন, এবং তখন তারা ফোন করে তার খোঁজ খবর নেবে।
বাইরের মানুষের অবশ্যি এই ভেতরের খবরগুলো জানার কথা না, তাই তারা এই গর্তটা দেখে বড়জোর একটু অবাক হতে পারে তার বেশি কিছু নয়। তবে তারা যদি আরেকটু ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে অবাক হবার মতো আরো কিছু বিষয় পেতে পারে। যেমন খোলা জায়গাটার এক কোনায় অনেকটুকু জায়গা জুড়ে যে পোড়া দাগটা আছে, তাদের মনে সন্দেহ হতে পারে এটা কোথা থেকে এসেছে! এই বাসার যে বাচ্চাটির মাথায় বৈজ্ঞানিক আইডিয়া গিজগিজ করছে সে তার রকেট তৈরি করার জন্যে যে জ্বালানী আবিষ্কার করেছিল সেটার প্রথম পরীক্ষাটি এখানে করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন সেখানে দাউ দাউ করে যে আগুন লেগেছিল সেটা এই এলাকার মানুষজন অনেকদিন মনে রাখবে।
মানুষজন যদি কৌতূহলী হয়ে আরো ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে তারা দেখবে একটা গাছের ডাল থেকে একটা মরা কাক ঝুলছে। কেন্দ্র একটা মরা কাক গাছ থেকে ঝুলছে সেই কারণটা কেউ জানে না, যে ঝুলিয়েছে সে নিজেও জানে না। তবে এটা ঝোলানোর পর দুইদিন এই এলাকার মানুষ কাকের কা কা চিৎকারে এক মুহূর্তের জন্যেও শান্তিতে থাকতে পারে নাই।
ভালো করে লক্ষ্য করলে মানুষজন এখানে দুটি ছাগলকে ঘুরে বেড়াতে দেখবে, একটির রং সবুজ অন্যটির গোলাপি। ছাগলের রং কখনোই সবুজ বা গোলাপি হতে পারে না তাই এটা অনুমান করা মোটেও কঠিন নয় যে এই দুটো ছাগলকে রং করা হয়েছে। কোরবানীর জন্যে ছাগল দুটো কেনা হয়েছিল কিন্তু বাচ্চাদের এই ছাগল দুটোর জন্যে মায়া পড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেগুলোকে জবাই করা হয়নি। এই অংশটুকু বোঝা সম্ভব কিন্তু কেন ছাগল দুটোকে রং করতে হলো সেটা কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে একটা বাঘের বাচ্চাকেও ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়, এই বাসার গাছ গাছালীর ভেতর একটা আস্ত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা দেখে যে কেউ অবাক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এটা মোটেও বাঘ নয়, এটা একটা বিড়াল। হলুদের উপর কালো ডোরাকাটা দাগ দেখে এটাকে প্রথমে বাঘের বাচ্চা মনে হলেও এটা মিউ মিউ করে ডাকে এবং এর ভেতরে বাঘের কোনো তেজ নেই। এই বাসার মানুষজন কেন একটা বিড়ালকে ধরে রং করে বাঘের বাচ্চা বানানোর চেষ্টা করেছে সেটা কেউ কখনো বুঝতে পারে নাই।
বিকেল বেলার দিকে এলে বাচ্চা কাচ্চাদের চেঁচামেচি এবং হই চই শুনে যে কেউ চমৎকৃত হবেন। শুধু এই বাসার বাচ্চারা নয়, তখন পাড়ার সব বাচ্চারা এখানে এসে হাজির হয়। এই ভোলা জায়গায় নানারকম খেলা চলতে থাকে, তবে সবচেয়ে দর্শনীয় হয় ফুটবল খেলা। মানুষজন সাধারণত ফাঁকা মাঠে ফুটবল খেলে কিন্তু এখানে ছোট বড় অনেক গাছের ফাঁকে ফাঁকে ফুটবল খেলা হয়। এখানে ফুটবল খেলার উত্তেজনা অনেক বেশি কারণ, খেলার সময় ফুটবল যে কোনো সময় যে কোনো গাছে লেগে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে চলে যেতে পারে। কেউ যদি এই মাঠের ফুটবল খেলাটা ভালো করে লক্ষ্য করে তাহলে তারা অবাক হয়ে আবিষ্কার করবে যে এখানে মানুষের পায়ে লেগে যত গোল হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি গোল হয়েছে গাছের গুঁড়িতে বল লেগে। শুধু যে বল গাছে ধাক্কা খায় তা নয়, যারা ফুটবল খেলছে তারাও যে কোনো সময় যে কোনো গাছে ধাক্কা খেয়ে উলটে পড়তে থাকে। যারা গোলকিপারের দায়িত্বে থাকে তারা সুবিধেজনক উত্তেজনায় গোলকিপাররা মাঝে মাঝে মাঠের মাঝখানে চলে যায় তখন হঠাৎ করে বল চলে এলে তারা কাছাকাছি যে কোনো দুটো গাছ দিয়ে গোলপোস্ট তৈরি করে নেয়। যারা ফুটবল খেলে তারা এসব ছোটখাটো খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামায় না। মাঠের দুই পাশে দুটো গোলপোস্ট নিয়ে খেলা শুরু হলেও একবার মাঠের একই দিকে দুটো গোলপোস্ট চলে এসেছিল সেরকম উদাহরণও আছে। এখানে ছেলেরা এবং মেয়েরা সমান ভাবে ফুটবল খেলে। ছোট বড় মাঝারী যে কোনো সাইজের প্লেয়ার চলে এলেও তাকে নিয়ে নেয়া হয়। এখানে যারা খেলে এবং যারা খেলা দেখে সবাই সমানভাবে আনন্দ পায়। খেলার মাঠের দিকে মুখ করে থাকা চারতলা দালানের একতালার জানালার সবগুলো কাঁচ যে ভাঙা তার সাথে এই ফুটবল খেলার একটা সম্পর্ক আছে।