.
মুশতাক আহমেদের বাসার দারোয়ান আজকে তাদের থামাল না। বরং হাসি হাসি মুখে বলল, যাও, স্যার বাসাতেই আছেন। মনে আছে তো, দুইতলা বাম দিকে।
বাচ্চারা বলল, জী, মনে আছে। থ্যাংকু।
দরজায় বেল বাজানোর পর আজকে একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। দেখে মনে হয় কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। টেবিলে মোশতাক আহমেদের সামনে বিশ একুশ বছরের একটা ছেলে বসে আছে, মুশতাক আহমেদ কিছু একটা বলছিলেন ছেলেটা শুনছিল। সবাইকে ঢুকতে দেখে মুশতাক আহমেদ কথা বন্ধ করে ওদের দিকে তাকালেন।
রিতু বলল, স্যার, আপনার এস.এম.এস পেয়ে চলে এসেছি।
গুড। কী খবর তোমাদের?
ভালো স্যার। আপনার এস.এম.এস পাওয়ার পর আরো অনেক বেশি ভালো।
আগেই বেশি আশা করে বসে থেকো না, দেখা যাক কী হয়। তোমরা একটু অপেক্ষা করো আমি এর সাথে একটা জরুরি কথা সেরে নিই।
ঠিক আছে স্যার। বলে সবাই খালি চেয়ারগুলোতে ভাগাভাগি করে বসল। মুশতাক আহমেদ ছেলেটার সাথে মামলা মোকদ্দমা নিয়ে কথা বলতে থাকলেন। কোথায় উকিল পাওয়া যাবে, কম টাকায় কীভাবে কাজ করা যায় এরকম কথাবার্তা।
কথা শেষ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে মুশতাক আহমেদ বাচ্চাদের দিকে তাকালেন।
রিতু জিজ্ঞেস করল, স্যার, আমাদের জন্যে কোনো খবর আছে?
একটু খানি খবর আছে, কিন্তু ঠিক তোমরা যেভাবে চাইছ সেরকম খবর এখনো নেই।
মানে?
তোমার নানা-কিংবা দাদা, যে এলাকাতে যুদ্ধ করেছেন আমরা সেই জায়গাটা মোটামুটি বের করেছি, কিন্তু ঠিক কোথায় মারা গেছেন বা তাকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে, কিংবা আসলে কবর দেওয়া হয়েছেই কিনা সেটা এখনো বের করতে পারিনি।
টিটন জিজ্ঞেস করল, দাদা কোথায় যুদ্ধ করেছেন?
পঞ্চগড় জগদল রৌমারী ঐ এলাকায়।
মিঠুন টিয়ার পেটে চিমটি কেটে জিজ্ঞেস করল, এই জায়গাগুলো কোনখানে? পাকিস্তানে নাকি?
টিয়া পেটে হাত বুলাতে বুলাতে ফিসফিস করে বলল, ধুর গাধা। পাকিস্তানে কেন হবে? নর্থ বেঙ্গলে।
রিয়া জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমন করে জায়গাটা বের করলেন?
মুক্তিযোদ্ধাদের লিস্ট আছে, কে কোথা থেকে ট্রেনিং নিয়েছে কে কোথায় যুদ্ধ করেছে। সেখানে নাম দিয়ে খুঁজেছি। অনেকে তালিকায় আছে, অনেকে তালিকায় নাই। যারা ঐ এলাকায় যুদ্ধ করেছে তাঁদের অনেকে যুদ্ধে মারা গেছে, অনেকে বয়স হয়ে মারা গেছে, অনেকে রোগে শোকে মারা গেছে, অনেককে আবার পরে মেরে ফেলেছে। যারা বেঁচে আছে তাঁদের সাথে আমাদের ভলান্টিয়াররা কথা বলেছে। সেই কথাবার্তা থেকে আমরা জেনেছি সেখানে আসাদ নামে একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিল- তাই অনুমান করছি।
দুর্ধর্ষ যোদ্ধা? আমার নানা দুধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন?
মুক্তিযোদ্ধা মানেই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তোমার নানা-
মিঠুন বাধা দিয়ে বলল, এবং দাদা।
হ্যাঁ এবং দাদা তার মাঝে আলাদাভাবে সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। যার নাম আসাদ সে তো সাহসী হবেই। আসাদ নামের মানে জানো তো?
টিয়া মাথা নাড়ল, জী, সিংহ।
হ্যাঁ। কাজেই তাঁর সিংহের মতো সাহস ছিল। এখন পর্যন্ত আমরা যেটুকু জানি সেটা হচ্ছে তোমার নানার দলটা সেখানে অক্টোবরের শুরু থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি যুদ্ধ করেছে। প্রচণ্ড যুদ্ধ। পাকিস্তানি আর্মিকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। তারপর দলটা দক্ষিণে সরে এসেছে। আমরা ডিটেল্স এখনো জানি না।
তিতু জিজ্ঞেস করল, কীভাবে জানব আমরা? কীভাবে জানব?
এই জায়গাটা একটুখানি ট্রিকি। ঐ এলাকাতে গিয়ে খোঁজাখুজি করতে হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ পেয়েছি, তার নাম হচ্ছে ইদরিস। ইদরিস মিয়া। তাকে খুঁজে বের করতে হবে। সে তোমার নানার সাথে ছিল। সে তোমার নানার খবর দিতে পারবে। কিন্তু মুশকিল হলো- মুশতাক আহমেদ মুশকিলের কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।
সবাই ধৈৰ্য্য ধরে অপেক্ষা করল এবং মুশতাক আহমেদ শেষ পর্যন্ত বললেন, মুশকিল হচ্ছে ইদরিস মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে ঐ এলাকাতেই আছে, কিন্তু কোথায় আছে কেউ জানে না। কয়েকটা গ্রাম আছে সেখানে, তার মাঝেই থাকার কথা। কোনো কিছু নিয়ে তার ভিতরে অনেক বড় ক্ষোভ কিংবা দুঃখ তাই সে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে। সবার চোখের আড়ালে চলে গেছে। তাকে যদি খুঁজে বের করতে পারি আমার ধারণা আমরা তোমাদের নানার,–কিংবা দাদার খোঁজ পেয়ে যাব।
টিটন জানতে চাইল, আমরা কেমন করে ওনার খোঁজ পাব?
ওখানে যেতে হবে। আমাদের ভলান্টিয়ার টিম সেখানে গিয়ে খুঁজে বের করবে?
কখন যাবে তারা?
সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। আমাদের অনেক ভলান্টিয়ার। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির ছেলে মেয়েরাই বেশি। তারা নানারকম কাজ করে। মুশতাক আহমেদ তার ঘরের ছেলেটিকে এবং মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, এই যে, এই দুইজন ভলান্টিয়ার। একটু পরে আরো কয়েকজন আসবে। সবাই কাজ করে যাচ্ছে। এরকম একটা টিম যাবে, ওখানে থেকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু
রিতু সোজা হয়ে বসে বলল, কিন্তু কী?
কিন্তু এই মুহূর্তে সবাই ব্যস্ত। এই সরকার এসে আমাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা দিয়ে তাদের জীবনটা নষ্ট করে দিচ্ছে। অনেককে জেলে পাঠিয়েছে। অনেকের চাকরি বাকরি নেই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ। কাজেই তাদেরকে সাহায্য করতে করতে পুরো এনার্জী চলে যাচ্ছে। আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। মাস দুয়েক পরে আমরা একটু ফ্রি হব। তখন মনে হয় ইদরিস মিয়াকে খুঁজে বের করতে পারব।