মিঠুন প্রায় আর্তনাদ করে বলল, হায় হায়! আপনার পা নাই!
সাথে সাথে সবাই একসাথে মিঠুনের ঘাড় ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, চুপ করবি তুই? চুপ করবি ছাগল কোথাকার?
মুশতাক আহমেদ বললেন, ওকে ছেড়ে দাও, ও তো ভুল বলে নাই। আমার তো আসলেই পা নাই।
মুশতাক আহমেদের কথা শুনে মিঠুন একটু সাহস পেলো। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছিল আপনার পায়ের?
সবাই আবার মিঠুনের ঘাড় চেপে ধরল। রিতু চাপা গলার হিস হিস করে বলল, তুই আরেকবার যদি মুখ খুলিস তোর গলা টিপে ধরব।
মুশতাক আহমেদ রিতুর কথাটা না শোনার ভান করে মিঠুনকে বললেন, যুদ্ধের সময় একটা শেল পড়েছিল, পা উড়ে গেছে। আমি জানে বেঁচে গেছি, আমার প্রাণের বন্ধু বাঁচে নাই। খুব মিস করি ওকে।
বিশ একুশ বছরের ছেলেটাও এগিয়ে এল, মুশতাক আহমেদ আর ছেলেটা মিলে কয়েকটা চেয়ার খালি করে দিল। সবাই তখন চেয়ার গুলোতে ভাগাভাগি করে বসল। টিটন মিঠুনকে নিজের চেয়ারে বসাল, আবার মুখ খুললে সময় মতো তার মুখ টিপে ধরার জন্য।
সবাই বসার পর মুশতাক আহমেদ সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা কী খাবে? চা না কফি?
রিতু বলতে যাচ্ছিল কিছুই লাগবে না, তার আগেই মিঠুন বলল, কফি। বেশি করে দুধ আর চিনি।
টিটন ফিস ফিস করে বলল, বাসায় কোনদিন তোকে কফি খেতে দেয় তুই যে এখানে কফি খেতে চাচ্ছিস?
মিঠুন ফিস ফিস করে বলল, সেই জন্যেই তো দেখতে চাই খেতে কী রকম।
রিতু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনল, বলল, আমাদের কিছু লাগবে না স্যার। আমরা এখনো চা কফি খাওয়া শিখি নাই।
ঠিক আছে যদি না শিখে থাকো তাহলে আমি শিখাতে চাই না।
মিঠুন একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল এবং সবাই সেটা না শোনার ভান করল।
মুশতাক আহমেদ কিছুক্ষণ তার আঙুলগুলো পরীক্ষা করলেন, তারপর সেই আঙুল দিয়ে টেবিলে কিছুক্ষণ টুক টুক করে শব্দ করলেন, তারপর বললেন, আমি ঠিক কী ভাবে তোমাদের বলব বুঝতে পারছি না, তোমরা এত ছোট। আমাদের মুক্তিযুদ্ধটাই হচ্ছে একটা খুব দুঃখের ইতিহাস। এত মানুষ এত আপনজনকে হারিয়েছে যে সেটা বলে বোঝানো যাবে না। তোমার নানার মতো মানুষের কিন্তু শেষ নেই। কত মুক্তিযোদ্ধা যে দেশের জন্যে যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়ে একেবারে সবার অজান্তে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে মানে হারিয়েই গেছে।
তোমার নানা-
মিঠুন মনে করিয়ে দিল, এবং দাদা।
মুশতাক আহমেদ হাসলেন, বললেন, হ্যাঁ নানা এবং দাদা তবুও তো তোমাদের স্মৃতিতে বেঁচে আছেন। তোমরা তাকে খুঁজে বের করতে চাইছ, দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। আমি চেষ্টা করব তাকে খুঁজে বের করতে। কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন, কার সাথে যুদ্ধ করেছেন, কী হয়েছে আমি বের করার চেষ্টা করব। কিন্তু-
বলে মুশতাক আহমেদ থেমে গেলেন। বাচ্চারা কোনো কথা না বলে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে। মুশতাক আহমেদ একটু পরে আবার শুরু করলেন। বললেন, কিন্তু আমি তোমাদের জোর দিয়ে বলতে পারছি না যে। আমরা তাকে খুঁজে পাবই পাব। এতোদিন আগের ব্যাপার, কতো তথ্য হারিয়ে গেছে। তাছাড়া সময়টা খুব খারাপ, গভমেন্ট হচ্ছে রাজাকারের গভমেন্ট, মাঝে মাঝে গভমেন্ট এমন ভাব করে যেন মুক্তিযুদ্ধ করাটাই যেন অপরাধ। রাজাকারে রাজাকারে দেশ ভরে গেছে।
মিঠুন গলা নামিয়ে বলল, রাজাকারের চামড়া তুলে নেব আমরা।
মুশতাক আহমেদ ঠিক শুনতে পেলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, কী বললে?
মিঠুন বলল, রাজাকারের চামড়া, তুলে নেব আমরা।
মিঠুনের কথা শুনে মুশতাক আহমেদ হা হা করে হাসলেন। বললেন, ভালোই বলেছ। ঠিকই বলেছ, রাজাকারের চামড়া তুলেই নেওয়াই দরকার। যাই হোক, আমরা যদি তোমার নানা কিংবা দাদাকে খুঁজে বের করতে চাই তাহলে সবার আগে কিছু তথ্য দরকার। তোমার নানা সম্পর্কে যা কিছু জান সব বলতে হবে। আমরা একটা ফর্ম তৈরি করে রেখেছি সেটা সবার আগে ফিলআপ করতে হবে। ইচ্ছে করলে এখন ফিলআপ করতে পার, ইচ্ছা করলে বাসায় নিয়ে যেতে পার, ফিলআপ করে পাঠিয়ে দিতে পার। তোমাদের ইচ্ছা।
রিতু বলল, আমরা আসলে কাগজে সব লিখে এনেছি এখনই ফর্মটা ফিলআপ করে যেতে পারব।
ভেরি গুড। তাহলে এখনই সব লিখে দাও। যত বেশি তথ্য দিতে পারবে তত ভালো। তোমাদের কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে না সেটাও লিখবে। বুঝেছ?
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।
রিতু তার ব্যাগ থেকে কাগজ বের করল, আর টিয়া বসে বসে লিখতে শুরু করল। সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়ালো, দেখতে লাগল যেন কোনো কিছু লিখতে গিয়ে ভুলে না হয়ে যায়।
আসাদ রহমানের সবকিছু লিখে দেবার পর রাহেলা খাতুনের সাথে বিয়ের সময় ভোলা ছবিটি ফর্মের এক কোনায় লাগিয়ে দিল। মুশতাক আহমেদ তখন ফর্মটা হাতে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, তারপর সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে বললেন, ভেরি গুড। আমরা যদি পজিটিভ কোনো খবর পাই তোমাদের আল্লু আম্মু কারো কাছে ফোন করে জানাব-
সবাই এক সাথে চিৎকার করে উঠল, না, না, না-
মুশতাক আহমেদ অবাক হয়ে বললেন, না? না কেন?
তিতু লাজুক মুখে বলল, আসলে এটা গোপন। আমরা যদি আসলেই নানার কবরটা পেয়ে যাই, তাহলে আমাদের নানিকে সেখানে নিয়ে অবাক করে দেব।
টিটন বলল, আমার নানির ষাট নম্বর জন্মদিন তো-এটা হবে আমাদের জন্মদিনের গিফট।
রিতু বলল, সেইজন্যে এইটা আমরা এখন বাসার কাউকে জানাতে চাই না।