সত্যি ম্যাডাম? সত্যি?
হ্যাঁ, আমার অফিসে একবার এসো দেখি তার ঠিকানা ফোন নম্বর খুঁজে পাই কিনা।
কী নাম উনার?
মুশতাক। মুশতাক আহমেদ।
থ্যাংক ইউ ম্যাডাম থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মাথা নাড়লেন তারপর অন্যমনস্ক ভাবে হেঁটে হেঁটে চলে গেলেন।
.
দুইদিন পর বিকাল বেলা দেখা গেল পাঁচ ভাই বোন জামা কাপড় পরে বাইরে যাওয়ার জন্যে রেডি হয়েছে। আশেপাশের বাসা থেকে যে বাচ্চা কাচ্চারা ফুটবল খেলতে এসেছে তারা একটু মন খারাপ করে অন্য কিছু খেলার কথা চিন্তা করলে লাগল। পাঁচজনের দলটি তাদের বড় চাচার (কিংবা বড় মামার) সাথে দেখা করল। বড় চাচা মাসুদ ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ ঠাণ্ডা গলায় বললেন, কী চাই? পঞ্চ তাণ্ডব কোথায় রওনা দিয়েছে?
টিটন বলল, আব্ব, আমরা মোটেও পঞ্চ তাণ্ডব না। আর কোথায় যাচ্ছি সেটা বলা যাবে না। সেইটা সিক্রেট।
বেআইনী কোনো কাজে না তো?
রিতু বলল, না বড় চাচ্চু।
ভেরি গুড। বলে মাসুদ তার বইয়ে ফিরে গেলেন, কিন্তু পাঁচজন চলে না গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল দেখে বললেন, কী ব্যাপার?
টিয়া বলল, রিকশা ভাড়া শর্ট পড়েছে?
কত রিকশা ভাড়া?
জানি না।
তাহলে?
মিঠুন বলল, বেশি করে দিয়ে দাও। যদি বেঁচে যায় আমরা ফুচকা খেয়ে নিব।
আর যদি কম পড়ে?
এমনভাবে দিবে যেন কম না পড়ে।
মাসুদ মিঠুনের বাস্তব বুদ্ধি দেখে চমৎকৃত হলেন। তিনি সত্যি সত্যি মানি ব্যাগ বের করে একটু বেশি করে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, ফুচকা খাওয়ার পর পেট খারাপ হলে খাওয়ার জন্য খাবার স্যালাইনের টাকাও দিয়ে দিচ্ছি।
মিঠুন বলল, খাবার স্যালাইন কিনে টাকা নষ্ট করা ঠিক হবে না। দরকার হলে বাসায় খাবার স্যালাইন বানিয়ে নিব। এক চিমটি লবণ এক মুঠ গুড় যায় এক গ্লাস পানি।
মাসুদ মিঠুনের বাস্তব বুদ্ধি দেখে দ্বিতীয় বার চমৎকৃত হলেন।
.
মুক্তিযুদ্ধ গবেষকের বাসার গেটে দারোয়ান তাদের আটকে দিল, কোথায় যাচ্ছ?
রিতু বলল, মুশতাক আহমেদের বাসায়।
উনি জানেন?
মিঠুন বলল, এখন জানবেন।
দারোয়ান ভুরু কুঁচকে মিঠুনের দিকে তাকাল, তারপর বলল, দাঁড়াও।
পাঁচ ভাই বোন দাঁড়িয়ে রইল এবং দারোয়ানটা একটু পরে ফিরে এসে বলল, যাও উপরে। দুই তালা বাম দিকে।
পাঁচজন সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। দরজায় শব্দ করার আগে রিতু মিঠুনের দিকে তাকিয়ে বলল, খবরদার কোনো উল্টা পাল্টা কথা বলবি না।
টিয়া বলল, তার চাইতে বল, খবরদার কোনো কথা বলবি না। মিঠুন কথা বললেই সেটা হবে উল্টা পাল্টা কথা।
মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, কোনও দিন না।
রিতু বেল টিপল এবং সাথে সাথে বিশ একুশ বছর বয়সের একজন। ছেলে দরজা খুলে দিয়ে বলল, আস, ভিতরে আস।
ঘরের এক পাশে একটা বড় টেবিল, টেবিলের পিছনে একজন একটা চেয়ারে বসে আছেন। মানুষটার উশখু খুশকু চুল এবং উশখু খুশকু দাড়ি। নাকের ডগায় চশমা। চশমার ওপর দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ও! তোমরা তাহলে সেই আন্ডাবাচ্চার দল। দারোয়ান ভুল বলে নাই।
বিশ বছরের যে ছেলেটা দরজা খুলে দিয়েছে সে বলল, না স্যার ভুল বলে নাই।
উশখু খুশকু চুল দাড়ির মানুষটা, যিনি নিশ্চয়ই মুশতাক আহমেদ হবেন। গবেষক বললে ঠিক এরকম একজন মানুষের চেহারা চোখে ভেসে ওঠে। মুশতাক আহমেদ বললেন, তা, তোমরা কী মনে করে? বেড়াতে নাকি কোনো কাজে।
রিতু বলল, কাজে।
অন্য সবাই রিতুর কথাটা সমর্থন করে জোরে জোরে মাথা নাড়ল।
মুশতাক আহমেদ বললেন, কী কাজ? শুনি।
রিতু বলল, আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাকে আপনার ঠিকানা দিয়েছেন। বলেছেন আপনি মুক্তিযুদ্ধের গবেষক।
ইন্টারেস্টিং।
ম্যাডাম বলেছেন আপনি নাকী মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করেন।
চেষ্টা করি। আজকাল মুক্তিযোদ্ধাদের পাওয়া কঠিন, কেউ নিজেদের পরিচয় দিতে চায় না। সব রাজাকার লাফিয়ে লাফিয়ে সামনে চলে আসে।
রিতু বলল, আমার নানা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
মিঠুন রিতুকে থামিয়ে বলল, আপুর নানা কিন্তু আমার দাদা। ব্যাপারটা যথেষ্ট পরিষ্কার হয়েছে কী না সেটা নিশ্চিত করার জন্য বলল, আমাদের তিনজনের দাদা আর দুইজনের নানা। আপন দাদা আর নানা। এক্কেবাওে পুরাপুরি আপন।
মুশতাক আহমেদ মিঠুনের কথা শুনে মুচকি হাসলেন, যদিও তার দাড়ি গোঁফের কারণে সেটা বোঝা গেল না। মুখে বললেন, বুঝতে পেরেছি।
রিতু চোখ পাকিয়ে মিঠুনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে একটু কথা বলতে দিবি?
মিঠুন বলল, বল আপু। বল।
আমাদের নানা কিংবা দাদা যেটাই বলেন, যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেন নাই।
মুশতাক আহমেদ তার দাড়ির মাঝে হাত ঢুকিয়ে বললেন, ভেরি ফেমিলিয়ার স্টোরি।
আমরা আপনার কাছে এসেছি একটা জিনিস জানার জন্য- রিতু কথার মাঝখানে থেমে গেল।
মুশতাক আহমেদ একটু ঝুঁকে বললেন, কী জিনিস?
আপনি কী, আপনি কী-বলতে পারবেন নানার কী হয়েছিল? নানা কোথায় কী ভাবে মারা গেছেন কিংবা তার কবরটা কোথায়?
মুশতাক আহমেদ তাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, বস। তোমরা বস।
ঘরে অনেকগুলো চেয়ার কিন্তু বেশির ভাগ চেয়ারের ওপরেই কিছু না কিছু আছে, বই, খাতা কিংবা কাগজপত্র। তারা কেমন করে বসবে বুঝতে পারল না। তখন মুশতাক আহমেদ চেয়ারগুলো খালি করার জন্যে চেয়ারটা ধাক্কা দিয়ে যখন একটু সামনে এলেন তখন সবাই বুঝতে পারল, মুশতাক আহমেদ আসলে চেয়ারে নয় একটা হুইল চেয়ারে বসে আছেন এবং তার হাঁটুর ওপর থেকে দুটি পা নেই।