কিছুক্ষণ অন্য সবাইও চুপ করে রইল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে টিয়া বলল, আসলে তিতু ভাইয়া ঠিকই বলেছে আমরা যদি দাদিকে দাদার কবরের কাছে নিতে পারি সেটা আসলেই খুবই ভালো জন্মদিনের গিফট হবে। কিন্তু আমরা তো জানি পর্যন্ত না দাদা কোথায় যুদ্ধ করেছে, কীভাবে মারা গেছে।
টিটন বলল, আচ্ছা, এটা কী কখনো কেউ খোঁজ নিয়েছে?
তিতু বলল, একটু একটু নিয়েছে।
রিতু জিজ্ঞেস করল,তুই কেমন করে জানিস?
নানিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নানি বলেছে। যুদ্ধের পর নানি খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু বেশি খোঁজ নিতে পারে নাই। দেশের অবস্থা খুব খারাপ ছিল, নানিও অনেক ঝামেলার মাঝে ছিল।
সবাই মাথা নাড়ল, তারা সবাই তাদের আব্ব আম্মুর কাছ থেকে গল্প শুনেছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা খুব কষ্টের মাঝে ছিল। তখন দুই বেলা খাওয়া জোগাড় করতেই রাহেলা খাতুনের জান বের হয়ে যেত। কাজেই তখন রাহেলা খাতুন ভালো করে তার স্বামীর খোঁজ নিতে পারেন নাই।
টিয়া জিজ্ঞেস করল, যখন আমাদের আব্ব চাছু ফুপুরা বড় হয়েছে। তখন তারা খোঁজ নেয় নাই?
তিতু বলল, নিতে চেষ্টা করেছে লাভ হয় নাই।
তুমি কেমন করে জান?
নানি বলেছে। সবাই জানে তিতুর সাথে রাহেলা খাতুনের একটা অন্যরকম সম্পর্ক, অনেক সময় সে নানির পায়ের কাছে বসে তার গল্প শুনে। এতো বড় হয়েছে এখনো মাঝে মাঝে নানির গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকে।
সবাই আরো কিছুক্ষণ বসে থাকে, তারপর রিতু সোজা হয়ে বসে বলল, ঠিক আছে। আজকের মিটিং তাহলে এখন শেষ। তিতু যেটা বলেছে সেটা ঠিক, আমরা যদি আসলেই নানার কবরটা খুঁজে বের করতে পারি সেটা হবে অসাধারণ। শেষ পর্যন্ত পারি আর নাই পারি একটু চেষ্টা করে দেখব। ঠিক আছে?
সবাই মাথা নাড়ল, এমন কী মিঠুনও। রিতু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, শুধু বুঝতে পারছি না কোথা থেকে শুরু করব। এখন দেশের গভমেন্টটাও রাজাকারের গভমেন্ট!
কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু মিঠুন হাত তুলে চিৎকার, করল, রাজাকারের চামড়া, তুলে নিব আমরা।
মিঠুনের সাথে চিৎকারে আর কেউ যোগ দিল না কিন্তু সবাই মনে মনে ভাবল কাজটা করতে পারলে আসলে খারাপ হতো না।
.
বাচ্চা কাচ্চারা প্রথমে তাদের আব্ব আম্মুর সাথে কথা বলল। তাদের কাছ থেকে তারা বিশেষ কিছুই জানতে পারল না। বাসায় আসাদ রহমানের সেরকম কোনো ছবি পর্যন্ত নেই। বিয়ের পর রাহেলা খাতুনের সাথে স্টুডিওতে তোলা একটা ছবি আছে সেটাই একমাত্র ছবি। কীভাবে তারা আসাদ রহমান নিয়ে খোঁজ-খবর শুরু করবে সেটাই যখন তারা বুঝতে পারছিল না তখন হঠাৎ করে রিতু শুরু করায় একটা পথ খুঁজে পেলো। পথটা দেখালেন এমন একজন যার কথা রিতু কখনো কল্পনা করেনি। মানুষটা হচ্ছে তাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম।
স্কুলে টিফিনের ছুটিতে সবাই দৌড়াদৌড়ি করে খেলছে। প্রত্যেক দিন রিতুও খেলে আজকে তার শরীরটা ভালো লাগছে না বলে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বসেছিল। আজকাল রিতু যখনই একা একা বসে সে তার নানার কথা চিন্তা করে, একটা মানুষ এভাবে পুরোপুরি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে সেটা কেমন করে হতে পারে?
রিতু খেয়াল করেনি যে তাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এবং রিতুকে বসে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে গেছেন। স্কুলে শত শত ছেলে মেয়ে, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আলাদাভাবে তাদের মনে রাখতে পারেন না কিন্তু এই তেজী মেয়েটার কথা তার মনে আছে। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম খুব বেশি হাসেন না কিন্তু আজকে হাসি হাসি মুখে বললেন, কী হলো? তুমি একা একা বসে আছ কেন?
রিতু প্রিন্সিপাল ম্যাডামের গলার স্বর শুনে লাফ দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল এবং নিজের পায়ের সাথে নিজের পা বেঁধে একেবারে হুড়মুড় করে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ওপর পড়ে গেল, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাকে খপ করে ধরে ফেললেন, বললেন, আরে! কী হলো! কী হলো!
রিতু লজ্জায় প্রায় মরে যাচ্ছিল, কোনোমতে বলল, সরি ম্যাডাম! সরি সরি সরি!
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, আমি সরি, তোমাকে এভাবে চমকে দেওয়ার জন্য! এতো মনোযোগ দিয়ে কী ভাবছিলে?
কিছু না ম্যাডাম কিছু না বলে হঠাৎ করে সে থেমে গিয়ে বলল, আসলে আমার নানার কথা ভাবছিলাম। আমার মুক্তিযোদ্ধা নানা।
প্রিন্সিপাল ম্যাডামের মুখটা এবারে একটু গম্ভীর হলো, শান্ত গলায় বললেন, ও।
জী ম্যাডাম।
এরপর একেবারে কিছু না বললে কেমন দেখায়? তাই প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, কী ভাবছিলে?
আসলে আমার নানা কখনো ফিরে আসেন নাই। নানা কোথায় যুদ্ধ করেছেন কোথায় মারা গেছেন কেউ জানে না।
সত্যি?
জী ম্যাডাম। এই জন্যে কয়েকদিন থেকে ভাবছিলাম কেমন করে আমার নানার খোঁজ পাওয়া যায়। কোনো উপায় আছে কিনা।
কিছু ঠিক করেছ?
নানার অনেক পুরানো একটা ছবি আছে, তার বিয়ের পর নানির সাথে তোলা ছবি। তাই ভাবছিলাম সেটা দিয়ে পত্রিকায় কোনো বিজ্ঞাপন দেয়া যায় কিনা, কেউ যদি কিছু জানে সেটা জানানোর জন্য। আপনার কী মনে হয় এটা কাজ করবে?
গুড আইডিয়া। ম্যাডাম কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, সময়টা খারাপ, বুঝেছ। মুক্তিযযাদ্ধারা কথা বলতে চায় না। ওদের ভিতরে এক ধরনের অভিমান।
রিতু কী বলবে বুঝতে পারল না তাই কয়েকবার মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মাথা ঘুরিয়ে রিতুর দিকে তাকালেন তারপর বললেন, আমার পরিচিত একজন আছেন, উনি হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক। ওনার কাজই হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করা। যে মুক্তিযোদ্ধারা খুব খারাপ অবস্থায় আছে তাদের বের করে সাহায্য করা। তুমি তার সাথে দেখা করে দেখতে পার, তোমাকে হয়তো সাহায্য করতে পারেন।