কয়েকদিন আগে টিটনের কয়েকজন বন্ধু তার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল, সারাদিন থেকে সবাই খুব মজা করে এসেছে। ক্লাসে সবার মাঝে টিটনদের বাসার ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে তখন কীভাবে কীভাবে জানি রাজাকার স্যারও তাদের বাসার একটা দুইটা ব্যাপার জানতে পেরেছেন। সেইজন্যে রাজাকার স্যার ক্লাশে টিটনকে ধরেছেন। টিটন কী বলবে বুঝতে পারছিল না তখন স্যার আবার খেঁকিয়ে উঠলেন, কথা বলিস না কেন? ডাকিস?
টিটন থতমত খেয়ে বলল, সব সময় ডাকি না, কখনো কখনো ডাকি।
তাহলে তোর মাকে তখন কী ডাকিস? দাদি?
টিটন বলল, মাকে ডাকি আম্মু।
স্যার মুখ খিঁচিয়ে বললেন, এটা কোন ধরনের ঢং? দাদিকে ডাকিস মা? বাবার স্ত্রী হচ্ছে মা। আর বাবার মা হচ্ছে দাদি। তার মানে তুই তোর বাবার মাকে বলছিস তার স্ত্রী। ছি ছি ছি!
টিটন একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল, ছোট থেকে সে দেখে এসেছে তার বাবা মা চাচা চাচি ফুপু ফুপা সবাই রাহেলা খাতুনকে মা ডাকে, তাদের দেখাদেখি তারা সব ভাই বোনই মাঝে মাঝে তাকে মা ডেকে এসেছে এর মাঝে যে কোনো প্যাঁচ আছে সেটা তো সে জানতো না।
টিটনদের ক্লাসে আশিকের খুব সাহস, সে দরকার হলেই রাজাকার স্যারের সাথে মুখে মুখে তর্ক করে। আজকেও সে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল, বলল, স্যার, নানি আর দাদির ইংরেজি হচ্ছে গ্র্যান্ড মাদার। মাদার মানে হচ্ছে মা। ইংরেজিতে যদি নানি দাদিকে মা ডাকা যায় তাহলে বাংলায় ডাকলে দোষ কী?
রাজাকার স্যার কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। যখন তার এরকম অবস্থা হয় তখন স্যার সব সময় যা করেন এবারেও তাই করলেন, বিকট একটা ধমক দিয়ে বললেন, ইংরেজি আর বাংলা কী এক জিনিস? ইংরেজি ভাষার কী কোনো মা বাপ আছে? ছারপোকার ইংরেজি করেছে বাঘ!
আশিকের সাহস আছে, সে শুদ্ধ করে দিয়ে বলল, স্যার বাঘ না, বাগ। বি ইউ জি বাগ।
রাজাকার স্যার হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বললেন, একই কথা!
কেমন করে একই কথা হলো সেটা কেউ বুঝতে পারল না কিন্তু সেটা নিয়ে আর কেউ তর্ক করার সাহস পেল না। তখন সুব্রত দাঁড়িয়ে বলল, স্যার আমরা তো ইংরেজিতে কথা বলি না আমরা তো বাংলায় কথা বলি। আমরা তো দাদি-নানিকে ঠাকুরমা দিদিমা বলি! সেটাও তো মা।
স্যার এমনভাবে সুব্রতের দিকে তাকালেন যেন সে মানুষ না, সে হচ্ছে একটা তেলাপোকা কিংবা কেঁচো। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, তোদের কথা আর কী বলব? তোরা তো মাটি দিয়ে একটা মূর্তি বানিয়ে সেটাকেও মা ডাকিস। ডাকিস না?
সুব্রত ভ্যাবেচেকা খেয়ে বসে গেল, টিটন দেখল বেচারা সুব্রতের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। রাজাকার স্যারের সবচেয়ে প্রিয় কাজ হচ্ছে ক্লাসের যে কয়জন হিন্দু ছাত্র আছে তাদেরকে নানাভাবে ধর্ম নিয়ে খোটা দেওয়া। টিটনের তখন একটু রাগ উঠে গেল, বলল, স্যার মা শব্দটা আসলে অন্য রকম। মানুষ যেটাকে ভালোবাসে সেটাকেই মা ডাকে। কাজেই কাকে মা ডাকা যাবে কাকে মা ডাকা যাবে না এরকম কোনো আইন নাই। মানুষ দেশকেও মা ডাকে। ভাষাকেও মা ডাকে।
টিটনদের ক্লাসে আলতাফ একটু কবি টাইপের, কয়দিন আগে সে টিটনদের বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। সে দাঁড়িয়ে দুই হাত নেড়ে চোখ ঢুলুঢুলু করে সুর করে বলল, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী ….
চুপ কর বেকুব। বলে রাজাকার স্যার ধমক দিয়ে আলতাফকে থামিয়ে দিলেন। মুখ বাঁকা করে বললেন, জননী জন্মভূমিশ্চ! হা! তারপর হায়েনার মতো খা খা করে হাসতে লাগলেন। রাজাকার স্যারের মাড়ি কালো রঙের, হাসির সময় ঠোঁটগুলো উপরে উঠে কালো মাঢ়ি বের হয়ে যায় তখন তাকে দেখায়ও হায়েনার মতো। ক্লাসের সবাই এই বীভৎস স্যারের বীভৎস হাসি বসে বসে শুনতে লাগল।
হাসি শেষ করে রাজাকার স্যার আবার টিটনের দিকে তাকালেন, বললেন, তুই যখন তোর দাদিকে মা ডাকিস তখন তোর বাবা মা আপত্তি করে না? আমি হলে তো চাবকে ছাল তুলে দিতাম।
টিটন মুখ শক্ত করে বলল, না স্যার। আপত্তি করে না।
কেন করে না?
টিটন কিছু বলার আগেই তার পাশে বসে থাকা পিয়াস দাঁড়িয়ে উঠে বলল, স্যার ওদের বাসা অন্যরকম। ওদের বাসায় কেউ রাগে না, বকে না ধমক দেয় না। সারা রাত টিভি দেখলেও কেউ না করে না। সবাই দিন রাত মজা করে।
পিয়াস মজার কয়েকটা উদাহরণ দিতে যাচ্ছিল কিন্তু রাজাকার স্যার ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে মুখ খিঁচিয়ে বললেন, মজা করে? দিন রাত মজা করে? ফাজলেমীর জায়গা পাস না?
তারপর রাজাকার স্যার কেন জীবনে কখনো মজা করতে হয় না এবং আনন্দ করতে হয় না এবং করলে কী সর্বনাশ হবে এবং যারা জীবনে খালি মজা করেছে আর আনন্দ করেছে তাদের কী বিপদ হয়েছে তার উপর বিশাল একটা লেকচার দিতে শুরু করলেন।
রাজাকার স্যারের গল্প শেষ করে টিটন ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যখন আরো ছোট ছিলাম তখন বুঝি নাই এখন বুঝতে পারছি আমাদের বাসাটা আসলে অন্য রকম।
মিঠুন হাত ওপরে তুলে চিৎকার করে উঠল, রাজাকারের চামড়া তুলে নিব আমরা।
রিতু ধমক দিয়ে বলল, মিঠুন তুই থামবি। সারাক্ষণ কানের কাছে ভ্যাদর ভ্যাদর করিস।
আমি মোটেই ভ্যাদর ভ্যাদর করছি না আপু।
তাহলে কী করছিস?
স্লোগান দিচ্ছি। মিটিংয়ের মাঝে সব সময় স্লোগান দেয়। তুমি টেলিভিশনে কোনোদিন দেখ নাই? একজন বক্তৃতা দেয় তখন অন্য সবাই স্লোগান দেয়?