টিয়া এবার একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, পরেরদিন স্যার খাতা দিতে এসেছেন। যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে তাকে প্রথমে দিলেন। তারপরে তার পরের জন, তারপরে তার পরের জন। এইভাবে দিতে দিতে দেখি সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। ক্লাশের দুইজন সবচেয়ে বড় ফাঁকিবাজ ছেলেদের খাতাও দেওয়া হলো, একজন পেয়েছে দুই আরেকজন গোল্লা। শুধু আমার খাতা দেওয়া হয় নাই। আমি দেখলাম স্যারের হাতে তখন মাত্র একটা খাতা বাকি, বুঝতে পারলাম সেইটা নিশ্চয়ই আমার খাতা! চিন্তা করো আমি পুরো ক্লাশে সবচেয়ে লাড্ড গাড্ডা! আমি একেবারে টাশকি মেরে গেলাম।
টাশকি মারার মতোই ব্যাপার, ঘটনাটা ছিল রীতিমতো হৃদয় বিদারক। তার কারণ স্যার সবার খাতা দেয়া শেষ করে টিয়ার খাতাটা হাতে নিয়ে বললেন, ক্লাসে কেউ আশি পেয়েছে কেউ তিরিশ পেয়েছে। খুবই দুঃখের কথা, একজন পেয়েছে দুই আরেকজন শূন্য। কিন্তু সবচেয়ে আজব ব্যাপার হচ্ছে এই খাতাটা- স্যার তখন টিয়ার খাতাটা ওপরে তুলে ধরে বললেন, এই যে খাতাটা আমার কাছে, আমি তাকে শূন্য দিতে পারি নাই। তাকে দিতে হয়েছে শূন্য থেকেও কম। দিয়েছি মাইনাস তিরিশ। ক্লাসে কেউ পাস করেছে কেউ ফেল করেছে, এই মেয়েটার ফেল করা নিয়েও টানাটানি!
টিয়ার তখন মনে হলো লজ্জায় টেবিলের নিচে ঢুকে পড়ে। একজন বলল, কেন স্যার? ফেল করা নিয়েও কেন টানাটানি?
সেটা জানতে চাস? তাহলে আমি একটু পড়ে শোনাই, স্যার তখন টিয়ার খাতাটার মাঝখানে থেকে মাঝখান থেকে পড়ে শোনালেন, আমাদের পরিবারে আমরা পাঁচ ভাই বোন। এখানেই শেষ নয় আছে দুইটা ছাগল একটার রং সবুজ অন্যটার গোলাপি।
স্যার এই টুকুন বলতেই সবাই উচ্চ স্বরে হেসে উঠল। স্যার বললেন, এই খানেই শেষ না, আরো শোন। এই মেয়ে লিখেছে, আরও আছে একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কিন্তু হলে কী হবে সেটা ডাকে মিউ মিউ মিউ।
আবার পুরো ক্লাস আনন্দে হো হো করে হেসে উঠল। স্যার বললেন, এই খানেই শেষ না। এখানে লেখা আছে তারা পুরো পরিবার একটা বাসায় থাকে, সেই বাসার নাম বক্কিলারে খা! আবার পুরো ক্লাশ হাসিতে ফেটে পড়ল। স্যার নিজেও হাসলেন- হাসতে হাসতে বললেন, এই মেয়ে লিখেছে তাদের বাসার সামনে একটা গর্ত আছে সেইখানে তার দাদি বলেছেন তিনি যখন মারা যাবেন তখন যেন কোনাকুনি ভাবে তাকে সেখানে কবর দিয়ে ফেলে। তারা ঠিক করেছে তাদের দাদি অন্ধকারে ভয় পাবেন বলে সেখানে একটা টিউব লাইট আর মোবাইল ফোন রেখে আসবে! তাদের দাদি তখন মাটির নিচে থেকে মিসকল দিবে!
ক্লাসের সবাই এবারে টেবিলে থাবা দিয়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়।
কিন্তু মজার জিনিস জানিস?
কী স্যার?
দাদিকে এই মেয়ে মাঝে মাঝে ডাকে মা! এটা শুনে সবাই অবাক হয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল।
খাতাটা পুরো ক্লাশকে পড়ে শুনিয়ে স্যার টিয়াকে দাঁড়াতে বললেন। টিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়াল। স্যার বললেন, তুই তো ক্লাশের ভালো ছাত্রীদের একজন। তুই খাতায় পাগলের মতো আবোল তাবোল কেন লিখেছিস?
টিয়া ভাবল একবার বলে, এগুলো আবোল তাবোল না। এগুলো সব। সত্যি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না।
স্যার বললেন, আমি চাই তোরা কোনো কিছু মুখস্ত করে নিজের মতো করে লিখতে শেখ। কিন্তু তার মানে এই না খাতায় আবোল তাবোল গাঁজাখুরি জিনিস লিখে বসে থাকবি। এটা তো পরীক্ষার খাতা, এটা তো হাসির গল্প লেখার কম্পিটিশান না। এই পরীক্ষার খাতা দেখে স্যার ম্যাডামরা মার্কস দেবে, সেই মার্কস পেয়ে তোরা পরীক্ষায় পাস করবি। এই সব লিখলে তো পাস হবে না। বুঝেছিস?
টিয়া মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।
কথাটা যেন মনে থাকে সেই জন্যে তোকে দিয়েছি মাইনাস তিরিশ। তোর লেখার স্টাইল ভালো, পড়তে ভালো লাগে পড়ে মনে হয় বুঝি সত্যি কথা! কিন্তু খবরদার পরীক্ষার খাতায় উল্টো পাল্টা জিনিস লেখা যাবে না।
টিয়া তার পুরো ক্লাসের বর্ণনা দিয়ে শেষ করার পর সবাই চুপচাপ বসে রইল, শুধু মিঠুন হাতে কিল দিয়ে বিকট স্বরে চিৎকার করে উঠল, জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো।
কে কোথায় আগুন জ্বালবে কেউ সেটা মিঠুনের কাছে জানতে চাইল না, কারণ সবাই জানে জানতে চাইলেই মিঠুন আরো একশ কথা বলতে শুরু করবে। তাকে যত কম উৎসাহ দেওয়া যায় ততই ভালো।
টিটন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, শুধু টিয়া না, আমাদের সবার এক অবস্থা।
মিঠুন ছাড়া অন্যেরাও মাথা নাড়ল- তাদের সবারই কখনো না কখনো টিয়ার মতো অবস্থা হয়, কখনো সেটা হয় মজার ঘটনা কখনো হয় দুঃখের ঘটনা। মিঠুন দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, টিয়া আপু তুমি একটা পচা ডিম নিয়ে ক্লাশে যাবে, তোমার স্যারের চেয়ারে রাখবে। যেই তোমার স্যার।
টিয়া বলল, আমি খামাখা স্যারকে শাস্তি দিব কেন? স্যার খুবই সুইট মানুষ। আমি অনেক বই পড়ি সেই জন্যে আমাকে খুব আদর করেন। আমাকে নিয়ে শুধু একটু মজা করেছেন।
টিটন বলল, তোর স্যার তো সুইট, আমার ঠিক উল্টা। স্যার পুরা রাজাকার। ক্লাশে আমাকে যা তা ভাবে অপমান করার চেষ্টা করেছে। আমার বন্ধুরা ছিল বলে সুবিধা করতে পারে নাই।
কী করেছে তোর স্যার?
টিটনের স্যার কী করেছে টিটন সেটার বর্ণনা দিল, বর্ণনাটা এরকম :
টিটনের ক্লাশে বাংলা পড়ান যে স্যার সেই স্যার রাজাকার টাইপের। আধুনিক রাজাকারদের মতো শার্টপ্যান্ট পরে, গালে সূক্ষ্ম এক ধরনের দাড়ি। তাদের বইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে কবিতাটা আছে সেটা কখনোই পড়ান না। একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, পয়লা বৈশাখ বা ষোলই ডিসেম্বরের আগে তার খুবই মেজাজ খারাপ থাকে। ক্লাসের কেউ তাকে দুই চোখে দেখতে পারে না, স্যারও কাউকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। সেই রাজাকার স্যার একদিন ক্লাশে এসে টিটনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ছেলে। তুই নাকি তোর দাদিকে মা ডাকিস?।