মিঠুনের কথা শুনে টিটনের বৈজ্ঞানিক ভাব চাড়া দিয়ে উঠল। সে বলল, মিঠুন, যে কোনো মানুষকে চাটলে নোনতা লাগবে। তার কারণ সব মানুষ ঘামে আর ঘামের সাথে শরীর থেকে লবণ বের হয়। লবণের টেস্ট হচ্ছে নোনতা। বুঝেছিস?
মিঠুন মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।
কী বুঝেছিস?
মানুষের ঘাম হচ্ছে নোতা। আর যাদের ডায়াবেটিস তাদের হিসি হচ্ছে মিষ্টি।
টিটন বলল, আমি মোটেও হিসির কথা বলি নাই-
রিতু মুখ বিকৃত করে তার কৌটায় চামুচ দিয়ে ঘটাং করে মেরে বলল, তোরা এখন চুপ করবি? কী সব নোংরা কথা বলছিস? ঘাম খেতে কেমন, হিসি খেতে কেমন! ছিঃ!
টিটন একটু খানি আপত্তি করে বলল, আমি কিন্তু কোনো নোংরা কথা বলি নাই, আমি শুধু সায়েন্টিফিক কথা বলেছি।
রিতু ধমক দিয়ে বলল, সায়েন্টিফিক কথার খেতা পুড়ি। চুপ করবি এখন?
টিটন চুপ করে গেল। সে আসলে বেশির ভাগ সময় চুপ করে থাকে তবে বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে কেউ ভুল কথা বললে সে আপত্তি না করে পারে না। রিতু সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা তাহলে মিটিং শুরু করি?
সবাই বলল, কর। শুধু টিয়া কোনো কথা বলল না। তার কারণ যদিও সে সবার আগে মিটিংয়ে এসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসেছে কিন্তু সে আসলে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে। তার আশে পাশে কী হচ্ছে সে জানে পর্যন্ত না। রিতু এবারে গলা উঁচিয়ে রিয়াকে বলল, টিয়া তোর বইটা বন্ধ করবি?
টিয়া মুখ না তুলে বলল, আর মাত্র দশ পৃষ্ঠা আপু!
রিতু কঠিন মুখে বলল, না, আর এক লাইনও না। বই বন্ধ কর।
টিয়া মুখ গোঁজ করে পৃষ্ঠা মুড়ে বই বন্ধ করল। হাত দিয়ে চশমাটাকে ঠেলে ওপরের দিকে তুলে বলল, ঠিক আছে। শুরু কর মিটিং।
রিতু সবার দিকে তাকালো, তারপর মুখটা হাসি হাসি করে বলল, ভাইসব-
টিয়া সাথে সাথে হাত তুলে বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও আপু, তোমার বলা উচিৎ ভাইসব এবং বোনসব। এখানে আমিও আছি, আমি মোটেও ভাই না। আমি বোন।
টিটন মাথা নেড়ে বলল, বোন সব বলে কোনো শব্দ নাই।
তিতু বলল, ইংরেজিতে সিবলিং বলে একটা শব্দ আছে। সিবলিং মানে ভাই বোন। বাংলায় সেরকম কোনো শব্দ নাই।
মিঠুন চিৎকার করে বলল, গুলগুলি, গুলগুলি।
রিতু চোখ পাকিয়ে বলল, গুলগুল্লি, আবার কী?
মিঠুন বলল, গুলগুলি মানে ভাই বোন। যেহেতু বাংলায় কোনো শব্দ নাই সেইজন্যে একটা শব্দ তৈরি করে দিলাম। আজকে থেকে গুলগুল্লি মানে ভাইবোন। আপু, তুমি বল, প্রিয় গুগগুলি-
রিতু গরম হয়ে বলল, ফাজলেমি করবি না মিঠুন। আমি বসেছি একটা জরুরি মিটিং করতে আর তোরা সারাক্ষণ বকর বকর করে যাচ্ছিস। চুপ করবি একটু?
মিঠুন বলল, ঠিক আছে চুপ করলাম।
রিতু রাগী রাগী গলায় বলল, আর যদি কেউ একটা কথা বলেছিস তাহলে এই চামুচ দিয়ে মাথার মাঝে দিব একটা বাড়ি।
মিঠুন লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, আমার কাছে দাও আপু, আমি বাড়ি দিয়ে দিই। তুমি খালি বলবে কাকে দিতে হবে আমি দিয়ে দেব।
সবার আগে তোর মাথায় একটা বাড়ি দেওয়া দরকার। চুপ করে বসবি এখন?
ধমক পেয়ে মিঠুন মুখটা বেজার করে বসে পড়ল। রিতু ঠিক যখন কথা বলবে তখন হঠাৎ টিয়া হাত তুলে বলল, আপু তুমি শুরু করার আগে আমি একটা কথা বলতে পারি?
কী কথা?
খুবই জরুরি কথা, অনেকদিন থেকে বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু সবাইকে এক সাথে পাই না। তাই বলতে পারি না। আজকে পেয়ে গেলাম।
ঠিক আছে বল, তাড়াতাড়ি।
টিয়া বলল, এটা শুধু বললে হবে না। এটা সবাইকে দেখাতে
হবে।
দেখা তাহলে।
টিয়া কোনো কথা না বলে পাশে রাখা তার ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে সেটা খুলে ধরল। টিটন জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী?
পরীক্ষার খাতা।
কী হয়েছে পরীক্ষার খাতায়?
দেখো কত পেয়েছি।
মিঠুন আনন্দে চিৎকার করে বলল, মাত্র তিরিশ পেয়েছ? তার মানে তুমি ফেল! হা হা! ফেল! ফেল! কী মজা।
ভালো করে দেখ গাধা।
সবাই ভালো করে দেখল, কিন্তু আসলেই খাতার ওপরে বড় বড় করে লাল কালিতে তিরিশ লেখা। রিতু ইতস্তত করে বলল, তিরিশই তো পেয়েছিস, এতো কম-
টিয়া মাথা নেড়ে বলল, আপু ভালো করে দেখো!
টিয়া কী দেখতে বলেছে টিটন সেটা প্রথম দেখতে পেল। অবাক হয়ে বলল, মাইনাস তিরিশ?
টিয়া মাথা নাড়লো, বলল, হ্যাঁ। মাইনাস তিরিশ। শূন্য থেকেও তিরিশ কম।
রিতু টিয়ার হাত থেকে খাতাটা নিয়ে দেখে, সেখানে আমার পরিবার নামে একটা রচনা লেখা। টিয়া বেশ সুন্দর করে লিখেছে কিন্তু লেখার মাঝখানে মাঝখানে স্যার লাল কলম দিয়ে দাগ দিয়ে বড় বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে রেখেছেন। রিতু একটু অবাক হয়ে বলল, স্যার তোকে মাইনাস তিরিশ কেন দিয়েছেন? ভালোই তো লিখেছিস।
টিয়া এবারে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, গত সোমবার বাংলা স্যার ক্লাশ এসে বললেন, সবাই আজকে রচনা লিখ। ছেলে মেয়েরা জিজ্ঞেস করল, কীসের ওপর লিখব? নিরক্ষরতার অভিশাপ? স্যার বললেন, না। তখন সবাই জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ? স্যার বললেন, না। তখন আরেকজন জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী জাতীয় জীবনের শিক্ষার গুরুত্ব? স্যার বললেন, না। তোরা যেগুলো মুখস্ত করে এসেছিস সেগুলো না। নিজে থেকে লিখতে হবে। সবাই রচনা লেখ আমার পরিবারের উপর। যারা মুখস্তের এক্সপার্ট তারা একটু গাঁই ছুঁই করল, তারপর লিখতে শুরু করল। আমিও লিখলাম।