রাত্রি চুল আঁচড়াচ্ছিল। মাকে দেখে অল্প হাসল। সুরমা মনে মনে ভাবলেন– এই মেয়েটি কি সত্যি আমার? এমন মায়াবতী একটা মেয়ের জন্ম দেবাব মত ভাগ্য আমার কী করে হয়? সুরমা বললেন, আয় চুল বেঁধে দি।
আস্তে করে বাঁধবে মা। তুমি এত শক্ত করে বাঁধ যে মাথাব্যথা করে।
রাত্রি মাথা পেতে দিল। তিনি চিরুনী টানতে টানতে বললেন–নাসিমার সঙ্গে তোর নাকি ঝগড়া হয়েছে?
ঝগড়া হবে কেন?
অপালা বলছিল।
অপালা কত কিছুই বলে।
ঝগড়া হয়নি তাহলে?
না। কি যে তুমি বল মা। আমি কি ঝগড়া করবার মেয়ে?
সুরমা শান্ত গলায় বললেন–তার মানে কি এই যে অন্য কোনো মেয়ে হলে ঝগড়া করত?
রাত্রি হেসে ফেলল, কোনো উত্তর দিল না। সুরমা বললেন, নাসিম তোকে কি বলছিল?
তেমন কিছু না।
সুরমা আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কারণ তিনি জানেন জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। কোনো জবাব পাওয়া যাবে না। রাত্রি বসে আছে মাথা নিচু করে। মেয়েটি প্রতিদিনই কি সুন্দর হচ্ছে? সুরমার সূক্ষ্ম একটা ব্যথা বোধ হল। রাত্রি মৃদু স্বরে বলল, ঐ ছেলেটি কে মা?
কোন ছেলে?
আমাদের বসার ঘরে যে ছেলেটি আছে?
তোর বাবার দূর-সম্পর্কের ভাগ্নে। আমি ঠিক জানি না।
কথাটা তো মা তুমি মিথ্যা বললে। আমি শুনেছি সে বাবাকে মতিন সাহেব, মতিন সাহেব বলছিল।
সুরমা বাঝাল স্বরে বললেন, আমি জানি না সে কে।
এটাও তো মা ঠিক না। তুমি কিছু না জেনেশুনে একটা ছেলেকে থাকতে দেবে না। তোমাব স্বভাবের মধ্যে এটা নেই।
সুরমা কিছু বললেন না। রাত্রি বলল, আমি কারোর সঙ্গে মিথ্যা কথা বলি না। কেউ যখন আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলে আমার ভাল লাগে না। সুরমা থেমে বললেন, ছেলেটি ঢাকায় গেরিলা অপারেশন চালানোর জন্যে এসেছে। তোর বাবা জুটিয়েছে। বুধবার পর্যন্ত থাকবে। এবা বেশি কিছু আমি জানি না।
রাত্রি কিছু বলল না। এটা একটা বড় ধরনের খবর। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা ব্যাপার। কিন্তু রাত্রির কোন ভাবান্তর হল না। সে যে ভাবে বসে ছিল সে ভাবেই বসে বইল।
নাসিমাদের বাসার টেলিফোন লাইনে কোন-একটা গণ্ডগোল আছে। টেলিফোন করলেই অন্য এক বাড়িতে চলে যায়। বুড়োমত এক ভদ্রলোক বলেন, ড. খয়ের সাহেবের বাড়ি। কাকে চান? আজ ভাগ্য ভাল। টেলিফোনে নাসিমাকে পাওয়া গেল। সুরমা বললেন, রাত্রির সঙ্গে তোমাব নাকি ঝগড়া হয়েছে? অপালা বলছিল।
ঝগড়া হয়নি ভাবী। যা বলার আমিই বলেছি। ও শুধু শুনেছে।
কি নিয়ে কথা?
রাত্রির বিয়ের ব্যাপারে। ছেলের মা এসেছিলেন রাত্রির সঙ্গে কথা বলতে। বাত্রি পাথরের মত মুখ করে বসে রইল।
আমাকে তো এসব কিছু বলনি!
বলার মত কিছু হয়নি।
আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা বলছি আর আমি কিছু জানিব না?
সময় হলেই জানবে। সময় হোক। ভাবী, রাত্রির জন্যে আমি যে ছেলে আনিব সে ছেলে তোমরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না। রাত্রির ব্যাপারটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। তোমার তো আরো একটি মেয়ে আছে। ওর বিয়ে তুমি দিও।
নাসিমা।
বল।
এ সময়ে মেয়ের বিয়ে-টিয়ে নিয়ে কথা হোক এটা আমি চাই না। মেয়ের আমি বিয়ে দেব সুসময়ে।
সুসময়ের দেরি আছে ভাবী। ছ’সাত বৎসরের ধাক্কা। তা ছাড়া…
তা ছাড়া কি?
এ রকম সুন্দরী অবিবাহিতা একটি মেয়ে এ সময় কেউ ঘরে রাখছে না। গণ্ডায় গণ্ডায় বিয়ে হচ্ছে রোজ। এইটি নাইনে পড়া মেয়েদেরও বাবা-মা পার করে দিচ্ছে। আমাদের নিচের তলার রফিক সাহেব কি করেছেন শোন…
সুরমা থমথমে গলায় বললেন, রফিক সাহেবের কথা অন্য একদিন শুনব। আজ না। আমার মাথা ধরেছে।
রাত এগারোটা প্রায় বাজে। মতিন সাহেব জেগে আছেন এখনো। রেডিও অস্ট্রেলিয়া শোনা হয়নি। রাত্রিও জেগে আছে। রেডিও অস্ট্রেলিয়া ধরে দেবার দায়িত্ব তার। ফাইন টিউনিং সে খুব ভাল পারে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর রাতে মতিন সাহেব মেয়ের সঙ্গে মৃদু স্বরে কথা বলতে পছন্দ করেন। কথা একনাগাড়ে তিনিই বলেন। অবিশ্বাস্য আজগুবি গল্প। রাত্রি কোনোটিতেই প্রতিবাদ করে না। হাসিমুখে শুনে যায়।
আজ মতিন সাহেব এক পীর সাহেবের গল্প ফাঁদলেন। পীর সাহেবের বাড়ি যশোহর। তিনি এখন কিছুদিনের জন্য আছেন ঢাকায়। টিক্কা খানের মিলিটারি এডজুটেন্ট নাকি তাকে নিয়ে গিয়েছিল ক্যান্টনমেন্টে। টিক্কা খান খুব বিনীতভাবে পীর সাহেবকে বললেন দোয়া করতে। উত্তরে পীর সাহেব বললেন – তোমাদের সামনে মহাবিপদ। তোমাদের একজনও এই দেশ থেকে প্ৰাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না। এক লাখ। কবর উঠবে বাংলাদেশে।
রাত্রি বলল, তুমি এই গল্প শুনলে কোথেকে? মতিন সাহেব বললেন, আমাদের ক্যাশিয়ার সাহেবের কাছে শুনলাম। উনি ঐ পীর সাহেবের মুরিদ। নিজেও খুব সুকী মানুষ। বানানো গল্প বলার লোক না।
মিলিটারি কি আর পীর-ফকিরের কাছে যাবে বাবা?
এমনিতে কি আর যাচ্ছে? ঠেলায় পড়ে যাচ্ছে? ঠেলায় পড়লে বাঘেও ধান খায়! কি রকম লেংগী যে খাচ্ছে তুই এখানে বসে কি বুঝবি। বুঝতে হলে ফ্রন্টে যেতে হবে। তবে দু’একটা দিন অপেক্ষা কর, দেখি কি হয়।
কী হবে?
আজাদহা নেমে গেছে। ঢাকা শহরে। কাকড়া বিছার দল। মিলিটারি কাঁচা খাওয়া শুরু করবে।
গেরিলারা ঢাকায় এসেছে নাকি বাবা?
আসবে না তো কি করবে। মার কোলে বসে থাকবে? ঢাকা ছেয়ে ফেলেছে। দু’একদিনের মধ্যে অপারেশন শুরু হবে। একবার অপারেশন শুরু হলে দেখবি সব কটা জেনারেলের আমাশা হয়ে গেছে। বদনা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে সবাই।