মেয়েটি ভেতরে চলে গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিবে এসে বলল, আপা আসবে না।
মতিন সাহেব খুব লজ্জায় পড়ে গেলেন। আলম বলল, তোমার নাম অপালা?
হ্যাঁ।
কেমন আছ অপালা?
ভাল।
বস।
না, আমি বসব না।
মেয়েটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এ রকম বাচ্চা মেয়ের চোখ এত তীক্ষ্ণ কেন? এদের চোখ হবে কোমল। আলম সিগারেট ধরাল f মেয়েটি এখনো তাকে মন দিয়ে লক্ষ্য করছে। কেন করছে কে জানে।
অপালা চোখ ফিরিয়ে নিল। শীতল গলায় বলল, আপনি প্রথম কদম ফুল বইটার একটা পাতা ছিঁড়ে ফেলেছেন। বই ছিড়লে আমি খুব রাগ করি।
আর ছিঁড়ব না।
পাতাও মুড়বেন না। এটা আমার খুব প্রিয় বই।
আলম হোসে ফেলল।
রাত্রি সারাদিন খুব গম্ভীর ছিল
রাত্রি সারাদিন খুব গম্ভীর ছিল। সন্ধ্যার পর আরো গম্ভীর হয়ে পড়ল। পৌনে আটটা থেকে আটটা পর্যন্ত বিবিসি বাংলা খবর দেয়। সে খবর শুনবার জন্যেও তার কোন আগ্রহ দেখা গেল না। সবাইকে বলল তার মাথা ধরেছে।
সুরমা অপালাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওর কি হয়েছে? অপালা গম্ভীর হয়ে বলল – ফুফুর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। সুরমা খুবই অবাক হলেন। রাত্রি কারো সঙ্গে ঝগড়া করার মেয়ে নয়। সে সব কিছুই নিজের মনে চেপে রাখে। সুরমা বললেন, কি নিয়ে ঝগড়া হল?
জানি না কি নিয়ে। ফুফু। ওকে আলাদা ডেকে নিল।
এতক্ষণ এই কথা বলিসনি কেন?
মনে ছিল না।
মনে ছিল না মানে?
আপা আমাকে কিছু বলতে মানা করেছে।
অপালা গল্পের বইয়ে মাথা ডুবিয়ে ফেলল। মার কোন কথাই আসলে তার মাথায় ঢুকছে না। তার বিরক্ত লাগছে। কোন একটা গল্পের বই শুরু করলে অন্য কিছু তার আর ভাল লাগে না। যে গল্পের বইটি সে নিয়ে বসেছে তার নাম আলোর পিপাসা। এই বইটি সে আগেও বেশ কয়েকবার পড়েছে। প্রতিটি লাইন তার মনে আছে, তবু পড়তে ভাল লাগছে। অপালার বয়স তেরো। রোগা বলে তাকে বয়সের তুলনায় ছোট মনে হয়। এটা তার খুব খারাপ লাগে। তেরো বছর বয়সটা তার পছন্দ নয়। যুদ্ধ শুরু হবার আগে তাদের যে প্রাইভেট মাস্টার ছিল তাকে একদিন সে বলেছেস্যার, আমার বয়স পনেরো। বেশি বয়সে পড়ালেখা শুরু করেছি। তো এই জন্যে ক্লাস এইটি পড়ি। ছোটবেলায় খুব অসুখ-বিসুখে ভুগতাম। পড়াশুনা করতে এই জনেই দেরি হয়ে গেল।
অপালার এ জাতীয় কথাবার্তা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় খুব ঝামেলা হয়েছিল। সুরমা শুধু বকা বকি করেই চুপ থাকেনি, চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন। প্রাইভেট মাস্টারটিকে বদলে দিয়ে বুড়ো ধরনের একজন টিচার রাখলেন। এ জাতীয় ঝামেলা অপালা প্রায়ই তৈরি করে। কয়েকদিন আগেই একটা হল। কি-এক উপন্যাস পড়ে তার খুব ভাল লেগেছে। উপন্যাসের নায়িকার নাম মনিকা। সে মনিকা নাম কেটে সমস্ত বইতে নিজের নাম বসিয়েছে। এ নিয়েও মা ঝামেলা করেছেন। তিনি সাধারণত বই-টই পড়েন না। অপালা কেন নায়িকার নামের জায়গায় নিজের নাম বসিয়েছে সেটা জানবার জন্যেই বইটি পড়লেন এবং রাগে তাঁর গা জ্বলে গেল। কারণ উপন্যাসের নায়িকা মনিকা তিনটি ছেলেকে ভালবাসে। ছেলেগুলি সুযোগ পেলেই তাকে জড়িয়ে ধরে। মনিকা কোন বাধা দেয় না। এর মধ্যে একটি ছেলে বেশি রকম সাহসী। সে শুধু গায়ে হাত দিতে চায়। মনিকা তার এই স্বভাব সহ্যই করতে পারে না, তবু তাকেই সে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। ভয়াবহ ব্যাপার।
অপালাকে নিয়ে সুরমার দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তাকে তিনি চোখে চোখে রাখতে চান। নিজে স্কুলে দিয়ে আসেন এবং নিয়ে আসেন। এখন স্কুল বন্ধ বলে এই ঝামেলাটা করতে হচ্ছে না। কিন্তু ওর কোনো টেলিফোন এলে তিনি আড়াল থেকে কথাবার্তা শুনতে চেষ্টা করেন।
রাত্রিকে নিয়ে এ রকম কোনো ঝামেলা হয়নি। রাত্ৰি যে বড় হয়েছে এটা সে কখনো কাউকে বুঝতেই দেয়নি। একবার শুধু খানিকটা অস্বাভাবিক আচরণ করেছিল। ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে যখন পড়ে তখনকার ঘটনা। গরমের ছুটি চলছে। সে সময় সকাল দশটায় এক ছেলে এসে উপস্থিত। সে নাকি রাত্রির সঙ্গে পড়ে। সেলিম নাম। সুরমা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন রাত্রি কেমন অতিরিক্ত রকমের ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কথাবার্তা বলতে লাগল উঁচু গলায়। শব্দ করে হাসতে লাগল। এবং এক সময় মাকে এসে বলল, মা ওকে আজ দুপুরে খেতে বলি? হলে থাকে, হলের খাবার খুব খারাপ। সুরমা ঠাণ্ডা গলায় বললেন–অজানা-অচেনা ছেলে দুপুর বেলায় এখানে খাবে কেন? ওকে যেতে বল। রাত্রি ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, অচেনা ছেলে নয় তো মা। আমার সঙ্গে পড়ে।
সুরমা শক্ত গলায় বললেন, ক্লাসের ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা দেবার জন্যে দুপুর বেলায় বাসায় আসে–এটা আমার পছন্দ নয়। ওকে যেতে বল।
এটা আমি কি করে বলব মা?
যেভাবে বলার সেভাবে বলবি।
রাত্রি চোখ-মুখ লাল করে কথাটা বলতে গেল। এবং বলে এসে সমস্ত দিন কাদল। সুরমা কিছুই বললেন না। কারণ তিনি জানেন এই সাময়িক আবেগ কেটে যাবে। এখানে তাঁকে শক্ত হতেই হবে। ছেলেটিকে তিনি যদি খেতে বলতেন সে বার বার ঘুরে ঘুরে এ বাড়িতে আসত। রাত্রির মত একটি মেয়ের সঙ্গে গল্প করার লোভ সামলানো কঠিন ব্যাপার। মেয়ে হয়েও সুরমা তা বুঝতে পারেন। বারবার আসা-যাওয়া থেকে একটা ঘনিষ্ঠতা হত। এই বয়সে কাঁচা আবেগের ফল কখনো শুভ হয় না।
সুরমা ভেবে পেলেন না। রাত্রি তার ফুফুর সঙ্গে কি নিয়ে ঝগড়া করবে? তার ফুফুকে সে খুবই পছন্দ করে। তাদের যে সম্পর্ক সেখানে ঝগড়া হবার সুযোগ কোথায়? নাসিমাকে একটা টেলিফোন করা যেতে পারে। কিন্তু তার আগে রাত্রির সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু রাত্রি কী কিছু বলবে? সুরমা অস্বস্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।