আলম একটা রিকশা নিল। বুড়ো রিকশাওয়ালা। ভারী রিকশা টানতে কষ্ট হচ্ছে, তবু প্যাডেল করছে প্ৰাণপণে। সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে একটা বরযাত্রীর দল দেখা গেল। নতুন বর বিয়ে করে ফিরছে। বিশাল একটা সাদা গাড়ি মালা দিয়া সাজানো। ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে পড়ায় গাড়ি থেমে আছে। আশপাশের সবাই কৌতূহলী হয়ে দেখতে চেষ্টা করছে বর-বউকে। আলমের মনে হল–দেশ যখন স্বাধীন হবে তখন কি এই ছেলেটি একটু লজ্জিত বোধ করবে না? যখন তার যুদ্ধে যাবার কথা তখন সে গিয়েছে বিয়ে করতে। আজ রাতে সে কি সত্যি সত্যি কোনো ভালবাসার কথা এই মেয়েটিকে বলতে পারবে?
সিগন্যাল পেরিয়ে বরের গাড়ি চলতে শুরু করেছে। বর একটা রুমালে মুখ ঢেকে রেখেছে। বিয়ে হয়ে যাবার পর সাধারণত বররা রুমালে মুখ ঢাকে না। এই ছেলেটি ঢাকছে কেন? সে কি নিজেকে লুকাতে চেষ্টা করছে? দুঃসময়ে বিয়ে করে ফেলায় যে কি খানিকটা লজ্জিত?
জুন মাসে ইয়াদনগরে নদী পার হবার সময় এ রকম একটা বরযাত্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দশ-বারো জনের একটা দল। দু’টি নৌকায় বসে আছে। সবার চেহারাই কেমন অস্বাভাবিক। জবুথবু হয়ে বসে আছে। বর ছেলেটি শুটকো মত। তাকে লাগছে উদভ্ৰান্তের মত। এরা লগীতে নৌকা বেঁধে বসে আছে চুপচাপ। আলমদের দলে ছিল বহমান। সে সব সময়ই বেশি কথা বলে। বরযাত্রী দেখে হাসিমুখে বলল, কি বিয়ে কবতে যান? সাবধানে যাবেন। লঞ্চে করে মিলিটারি চলাচল করছে। ঘনঘন পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলবেন। নওশাকে পাগড়ী পরিয়ে নৌকার গলুইয়ে বসিয়ে রাখলে কেউ কিছু বলবে না। বরযাত্রী দল থেকে কেউ একটি কথাও বলল না। একজন বুড়ো শুধু বিড়বিড় করতে লাগল। বর ছেলেটি কর্কশ গলায় তাকে ধমক দিল চুপ করেন। অত্যন্ত রহস্যময় ব্যাপার।
কিছুক্ষণের মধ্যে জানা গেল, এরা কনে নিযে ফিরছিল। বড় নদী ছেড়ে ছোট নদীতে ঢুকার সময় মিলিটারিদের একটা লঞ্চ এদের থামায়, কনে এবং কনের ছোটবোনকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। ছোট বোনটির বয়স এগারো।
আলম বলল, আপনারা কিছুই বললেন না?
কেউ কোনো উত্তর দিল না। রহমান বলল, খামোক এইখানে নৌকা থামিয়ে বসে আছেন কেন? বাড়ি চলে যান। তারপর আবার ছেলের বিয্যের ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশে কি মেয়েব অভাব আছে? অভাব নাই।
লোকগুলি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যেন কারোর কোন কথাই তাদের মাথায় ঢুকছে না।
আলম ঝিকাতলায় পৌঁছল বিকেল চারটায়। বৃষ্টি পড়ছে টিপটপ কবে। আকাশ মেঘে মেঘে কালো। অন্ধকার হয়ে এসেছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি খুঁজতে হবে। খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। সময় অল্প কার্ফুর আগেই ফিরতে হবে।
বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল সহজেই। ঝিকাতলা ট্যানারির ঠিক সামনে ৩৩ নম্বর বাড়ি। দোতলাদালানের উপরের তালায় থাকেন নজিবুল ইসলাম আখন্দ। কনট্রাক্ট পয়েন্ট।
দোতলায় উঠে আলমের বিস্ময়ের সীমা বইল না। বিশাল এক তালা ঝুলছে বাড়িতে। দরজা জানালা সবই বন্ধ। তালার সাইজ দেখেই মনে হচ্ছে। এ বাড়ির বাসিন্দারা দীর্ঘদিনের জন্যে বাইরে গেছে এবং সম্ভবত আর ফিরবে না।
একতলায় অনেক ধাক্কাধাব্ধি করবার পর দরজা একটুখানি খুলল। ভয়ে সাদা হয়ে যাওয়া একটি মেয়ে বলল, কাকে চান?
আখন্দ সাহেবকে। নজিবুল ইসলাম আখন্দ।
উনি দোতলায় থাকেন। এখন নাই।
কোথায় গেছেন?
দেশের বাড়িতে।
ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে গেছেন।
হ্যাঁ।
কবে গেছেন।
তিন দিন আগে। উনার ছোট ভাই মারা গেছে দেশের বাড়িতে।
ও আচ্ছা।
মেয়েটি দরজা বন্ধ করে দিল। এ তো একটা সমস্যায় পড়া গেল। আলম। শুকনো মুখে বের হয়ে এল। বাসায় ফিরল হেঁটে হেঁটে। ফোঁটা ফোটা বৃষ্টি। এর মধ্যে হাঁটতে ভালই লাগছে। তার সারাক্ষণই মনে হতে লাগল বাসায় পৌঁছে দেখবে সাদেক বিরক্তমুখে অপেক্ষা করছে। পরদিনই কাজে নেমে পড়া যাবে। কাজকর্ম ছাড়া চুপচাপ বসে থাকাটা আর সহ্য হচ্ছে না।
বারান্দায় উদ্বিগ্ন মুখে মতিন সাহেব দাঁড়িয়ে ছিলেন। আলমকে দেখেই বললেন, কাউকে কিছু না বলে কোথায় গিয়েছিলেন? আমি চিন্তায় অস্থির। একটু পরেই কার্ফু শুরু হয়ে যাবে।
আলম সহজ স্বরে বলল, আমার কাছে কেউ এসেছিল?
না, কেউ আসে নাই। ভিজতে ভিজতে এলে কোথেকে? গিয়েছিলে কোথায়?
আলম কোনো জবাব না দিয়ে বসার ঘরে ঢুকে পড়ল। বসার ঘরের সাজসজ্জার কিছু পরিবর্তন হয়েছে। সোফী একপাশে সরিয়ে একটা ক্যাম্পখাট পাতা হয়েছে। ক্যাম্পখাটে অচিন্তকুমারের প্রথম কদম ফুল। তার মানে শোবার জায়গার বদল হয়েছে। মতিন সাহেব ইতস্তত করে বললেন, আমার মেয়েরা চলে এসেছে। কাজেই তোমাকে বসার ঘরে নিয়ে এলাম। তোমার অসুবিধা হবে না তো?
না, অসুবিধা কিসের?
আমার বড় মেয়ে একটু ইয়ে ধরনের মানে…মতিন সাহেব কথা শেষ করলেন না, মাঝ-পথে থেমে গেলেন। আলম বলল, আমার কোনো অসুবিধা নেই। আপনি চিন্তা করবেন না।
মতিন সাহেব নিচু গলায় বললেন, আলম আরেকটা কথা ইয়ে–মানে আমাদের আরেকটা বাথরুম যে আছে ঐটিতে তুমি যাবে। ঐটা আমি পরিষ্কার করেছি। মানে প্রবলেমটা তোমাকে
আপনাকে প্রবলেম বলতে হবে না। আমার কোনো অসুবিধা নেই।
আলম সিগারেট ধরিয়ে ক্যাম্প খাটে বসল। মতিন সাহেব হা হা করে উঠলেন, ভেজা কাপড়ে বিছানায় বসছ কেন? কাপড় জামা ছাড়া। আমি তোমার জন্য শার্ট আর লুঙ্গি কিনেছি।
থ্যাংক য়্যু।
বারো-তেরো বছরের শান্ত চেহারার একটি মেয়ে উঁকি দিল। এর নামই বোধ হয়। অপালা। মতিন সাহেব বললেন, তোর আপাকে ডেকে আন, পরিচয় করিয়ে দেই।