পাশের ঘর থেকে সেলাই মেশিনের খাটাং খটাং শব্দ হচ্ছে। মেশিন চলছে তো চলছেই। রাতদিন এই মহিলা কি এত সেলাই করেন কে জানে? ক্লান্তি বলেও তো একটা জিনিস মানুষের আছে। খট খাট খাটাং চলছে তো চলছেই। গতকাল রাত এগারোটা পর্যন্ত এই কাণ্ড।
আলম হাত বাড়িয়ে ‘প্রথম কদম ফুল’ টেনে নিল। ছাপন্ন পৃষ্ঠা খুঁজে বের করতে ইচ্ছা করছে না। যে কোনো একটা জায়গা থেকে পড়তে শুরু করলেই হয়। তার আগে একবার বাথরুমে যেতে পারলে ভাল হত। এটা একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার। দু’টি বাথরুম এ বাড়িতে। একটি অনেকটা দূরে সার্ভেন্টস বাথরুম। অন্যটি এদের শোবার ঘরের পাশে। পুরোপুরি মেয়েলি ধরনের বাথরুম। ঝকঝাক তকতক করছে। ঢুকলেই এয়ার ফেশনাবেব মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায়। বিশাল একটি আয়না। আয়নার নিচেই মেয়েলি সাজসজার জিনিস। চমৎকার করে গোছানো। আয়নার ঠিক উল্টোদিকে একটি জলরঙ ছবি ফ্রেমে বাঁধানো। গামছা পরা দু’টি বালিকা নদীতে নামছে। চমৎকার ছবি। আয়নার ভেতর দিয়ে এই ছবিটি দেখতে বড় ভাল লাগে। এ জাতীয় একটি বাথরুম বাইরের অজানা-অচেনা এক মানুষের জন্যে নয়।
আলম বই নামিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আর ঠিক তখনই সেলাই মেশিনের শব্দ থেমে গেল। সে এই ব্যাপারটি আগেও লক্ষ্য করেছে। ঘর থেকে বেরুলেই ভদ্রমহিলা সেলাই থামিয়ে অপেক্ষা করেন। কিভাবে তিনি যেন টের পেয়ে যান। আলম বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই সুরমা বেরিয়ে এলেন। তার চোখে বুড়োদের মত একটা চশমা। মাথায় ঘোমটা দেয়া। এটিও আলম লক্ষ্য করেছে–ভদ্রমহিলা মাথায় সব সময় কাপড় দিয়ে রাখেন। হেড মিসট্রেস হেড মিসট্রেস মনে হয় সে কারণেই।
সুরমা বললেন, তোমার কিছু লাগবে?
না, কিছু লাগবে না।
লাগলে বলবে। লাজ করবে না।
জি, আমি বলব।
আমাদের টেলিফোন ঠিক হয়েছে। তুমি যদি কাউকে ফোন করতে চাও বা তোমার বাসায় খবর দিতে চাও দিতে পার।
না, আমার কাউকে খবর দেবার দরকার নেই।
সারাক্ষণ ঐ ঘরটায় বসে থাক কেন? বসার ঘরে এসে বসতে পার। বারান্দায় যেতে পার।
আলম চুপ করে রইল। সুরমা বললেন, তুমি তো কোনো কাপড় জমা নিয়ে আসনি। রাত্রির বাবাকে বলেছি তোমার জন্যে শার্ট নিয়ে আসবে। ও তোমার জন্যে কিছু টাকাও রেখে গেছে। বাইরে-টাইরে যদি যেতে চাও তাহলে রিকশা ভাড়া দেবে।
আমার কাছে টাকা আছে।
তুমি কি কোথাও বেরুবে?
দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করব। দুপুরের মধ্যে যদি কেউ না আসে তাহলে বেরুব।
কারোর কি আসার কথা?
হ্যাঁ।
তুমি যখন না থাক তখন যদি সে আসে তাহলে কি কিছু বলতে হবে?
না, কিছু বলতে হবে না। সে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে।
সুরমা ভেতরে চলে গেলেন। আবার সেলাই মেশিনের খটখট শব্দ হতে লাগল। ভদ্রমহিলার মাথা ঠিক নেই বোধহয়। কোন সুস্থ মানুষ দিনরাত একটা মেশিন নিয়ে খটখট করতে পারে না। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। অবশ্যি এখন সময়টাই অস্বাভাবিক। সে জন্যেই বোধ হয় চমৎকার এই সকালটাকে মানাচ্ছে না। দুর্বঘাসের উপর সুন্দর রোদ। বাতাসে সবুজ ঘাস কাপছে, রোদও কাঁপছে। অস্বাভাবিক এই বন্দি শহরে এটাকে কিছুতেই মানানো যাচ্ছে না। আলম সিগারেট ধরাল। বিন্তি মেয়েটি নারকেল গাছের নিচে পা ছড়িয়ে বসে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। এই মেয়েটি কি সব সময়ই হাসে? এত সুখী কেন সে?
দুপুর তিনটায় আকাশ মেঘলা হয়ে গেল। বাতাস হল আর্দ্র। দুপুরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে বোধ হয়। আলম গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। আকাশের দিকে। মেঘের গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা হয়ত। কতক্ষণে বৃষ্টি নাবমে আঁচ করা। বিন্তি বলল, কই যান?
কাছেই।
পাঁচটার আগে আইবেন কিন্তু। ‘কারপু’ আছে।
আসব, পাঁচটার আগেই আসব।
পানওয়ালা ইদ্রিস মিয়াও দেখল ছেলেটি মাথা নিচু করে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে। সেও তাকিয়ে রইল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। রাস্তাঘাটে লোক চলাচল কম। অল্প যে কজন দেখা যায় তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, দু’একটা কথা বলবার জন্যে মন চায। ইদ্রিস মিয়া কোনো কথা বলল না। সে আজ চোখে সুরমা দিয়েছে সে জন্যে বোধ হয় চোখ কড় কড় করছে। কিংবা হয়ত চোখ উঠবে। চোখ-উঠা রোগ হয়েছে। চায়দিকে সবার চোখ উঠছে।
আলম হাঁটতে হাঁটতে বলাকা সিনেমা হলের সামনে এসে দাঁড়াল। ঢাকা শহরে প্রচুব আর্মির চলাচল বলে যে কথাটা সে শুনেছিল, সেটা ঠিক নয়। আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে সে একটা মাত্র ট্রাক যেতে দেখেছে। সেই ট্রাকে ছাইরঙা পোশাক পরা একদল মিলিশিয়া বসে আছে। সাধারণত ট্রাকে সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এরা বসে আছে কেন? ক্লান্ত?
চোখে পড়ার মত পরিবর্তন কি কি হয়েছে এই শহরে? আলম ঠিক বুঝতে পারল না। সে সম্ভবত আগে কখনো এ শহরকে ভালভাবে লক্ষ্য করেনি। প্রয়োজন মনে করেনি। এখন কেন জানি ইচ্ছা করছে আগের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে। চারদিকে কেমন যেন পবিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মনে হচ্ছে। পুয়ানো বইপত্রের হকাররা যে জায়গাটা দখল করে থাকত সেটা খালি। একটি অন্ধ ভিখিরী টিনের মগ নিয়ে বসে আছে। একে ছাড়া অন্য কোন ভিখিরী চোখে পড়ে না। সব ভিখিরীকে কি এরা মেরে শেষ করে দিয়েছে? দিয়েছে হয়ত।
রিকশায় কিছু বোরকা পরা মহিলা দেখা গেল। মেয়েরা কি আজকাল বোরকা ছাড়া রাস্তায় নামছে না? কিছু কিছু রিকশায় ছোট ছোট পাকিস্তানি ফ্ল্যাগ। চাঁদ তারা আঁকা এই ফ্ল্যাগের বাজার এখন নিশ্চয়ই জমজমাট। যেখানে-সেখানে এই ফ্ল্যাগ উড়ছে। এর মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার ভাবও আছে। কার পতাকাটি কত বড়। লাল রঙের তিনকোণা এক ধরনের পতাকাও দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে কি-সব আরবি লেখা। লেখাগুলি তুলে ফেললেই এটা হয়ে যাবে মে দিবসের পতাকা।