সুরমা যথেষ্ট সংযত আচরণ করছে বলে তাঁর ধারণা। এখনো ছেলেটিকে নিয়ে কোন হৈচৈ করেনি। প্রথম ধাক্কাটা কেটে গেছে। কাজেই আশা করা যায় বাকিগুলিও কাটবে। অবশ্যি ছেলের আসল পরিচয় জানলে কি হবে বলা যাচ্ছে না। প্রয়োজন না হলে পরিচয় দেয়ারই বা দরকার কী? কোন দরকার নেই।
স্বাধীন বাংলা থেকে দেশাত্মবোধক গান হচ্ছে। তিনি গানের তালে তালে পা ঠুকতে লাগলেন–ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা। আমাদের এই বসুন্ধরা। তার চোখ ভিজে উঠল। এইসব গান আগে কতবার শুনেছেন কখনো এ রকম হয়নি। এখন যতবার শোনেন চোখ ভিজে উঠে। বুক হুঁ-হু করে।
রেডিওটা কান থেকে নামাও।
মতিন সাহেব ট্রানজিস্টারটা বিছানার উপর রাখলেন। নিজে থেকে কোনো প্রশ্ন করতে সাহসে কুলাচ্ছে না। সুরমা বললেন, কাল তুমি তোমার বোনের বাসায় গিয়ে বলে আসবে রাত্রি এবং অপালা যেন এক সপ্তাহ এখানে না আসে।
কেন?
তোমাকে বলতে বলছি, তুমি বলবে। ব্যস। এই মাসটা ওরা সেখানেই থাকুক।
আচ্ছা বলব।
আরেকটা কথা।
বল।
ভবিষ্যতে কখনো আমাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করবে না।
আচ্ছা। এক কাপ চা খাওয়াবে?
এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে সুরমাকে সামনে থেকে সবিয়ে দেয়া। সে বসে থাকা মানে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বঞ্চিত হওয়া।
রাত দশটায় ভয়েস অব আমেরিকা থেকেও একটা ভাল খবর পাওয়া গেল। পূর্ব রণাঙ্গনে বিদ্রোহী সৈন্য এবং পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর ভেতর খণ্ড যুদ্ধ হয়েছে বলে অসমর্থিত খবরে জানা গেছে। তবে পূর্ব পাকিস্তানে সমগ্র ছোট বড় শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে। আমেরিকান দু’জন সিনেটর ঐ অঞ্চলের ব্যাপক প্রাণহানিব খবরে উদ্বেগ প্রকাশ কবেছে। সংকট নিরসনের জন্যে আশু পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে তারা মনে করেন।
ভাল খবর হচ্ছে পূর্ব রণাঙ্গনে খণ্ড যুদ্ধ। আমেরিকানদের খবর। এরা তো আর না জেনেশুনে কিছু বলছে না। জেনেশুনেই বলছে। রাত্রি নেই, সে থাকলে এসব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন। টেলিফোনটাও নষ্ট হয়ে আছে। ঠিক থাকলে ইশারা-ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করা যেত সে ভয়েস অব আমেরিকা শুনছে। কিনা।
মতিন সাহেব রেডিও পিকিং ধরতে চেষ্টা করতে লাগলেন। পাশাপাশি অনেকগুলি জায়গায় চ্যাং চ্যাং চিন মিন শব্দ হচ্ছে। এর কোনো একটি রেডিও পিকিংয়ের এক্সটারনাল সার্ভিস। কোনটা কে জানে। রাত এগারোটায় রেডিও অস্ট্রেলিয়া। মাঝে মাঝে রেডিও অস্ট্রেলিয়া খুব পরিষ্কার ধরা যায়। তারা ভাল ভাল খবর দেয়।
তিনি নব ঘুরাতে লাগলেন খুব সাবধানে। তার মন বেশ খারাপ। বিবিসির খবর শুনতে পারেননি। খুব ডিসটারবেন্স ছিল। একটা ভাল ট্রানজিস্টার কেনা খুবই দবকার।
রাত সাড়ে দশটায় ইলেকট্রিসিটি এল। সুবামা লক্ষ্য করল ছেলেটি বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় বসে আছে। সারাটা সময় কি এখানেই বসে ছিল? না ঘুমিয়ে পড়েছে বসে থাকতে থাকতে? তিনি এগিয়ে গেলেন। না ঘুমায়নি। জেগেই আছে। চোখে চশমা নেই বলে অন্য রকম লাগছে।
আলম, তোমার কি ঘুম আসছে না?
জি না।
গরম দুধ বানিয়ে দেব এক গ্লাস? গরম দুধ খেলে ঘুম আসে।
দিন।
সুরমা দুধের গ্লাস নিয়ে এসে দেখেন ছেলেটি ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে ডেকে তুলতে তার মায়া লাগল। তিনি বারান্দায় বাতি নিভিয়ে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন সেখানে।
আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। একটি দু’টি কবে তারা ফুটতে শুরু করেছে।
দুই সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে
দুই সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে একটি অচেনা বাড়িতে দু’দিন কেটে গেল। দু’দিন এবং তিনটি দীর্ঘ রাত। আজ হচ্ছে তৃতীয় দিনের সকাল। আলম পা বুলিয়ে বসে আছে। কাজের মেয়েটি এক কাপ চা দিয়ে গেছে। সে চায়ে চুমুক দেয়নি। ইচ্ছে করছে না। অস্থির লাগছে। পেয়াজ-রসুনের গন্ধটা সহ্য হচ্ছে না। সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। এই যন্ত্রণার উৎস নিশ্চয়ই পেঁয়াজ রসুনের গন্ধ নয়। সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার জন্যেই এ রকম হচ্ছে। দাম আটকে আসছে।
কথা ছিল সাদেক তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। যেদিন সে ঢাকা এসে পৌঁছেছে তার পরদিনই। যোগাযোগটা হবার কথা কিন্তু এখনো সাদেকের কোনো খোঁজ নেই। ধরা পড়ে গেল নাকি? দলের একজন ধরা পড়ার অর্থই হচ্ছে প্রায় সবারই ধরা পড়ে যাওয়া। এ কারণেই কেউ কারোর ঠিকানা জানে না। কাজের সময়ই সবাই একত্র হবে। তারপর আবার ছড়িয়ে পড়বে। ঝিকাতলার একটি বাসায় কনট্রাক্ট পয়েন্ট। সেখানেও যাবার হুঁকুম নেই। নিতান্ত জরুরি না হলে কেউ সেখানে যাবে না।
সবার দায়িত্ব ভাগাভাগি করা আছে। মালমশলা জায়গামত পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব রহমানের। সেগুলি নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে। রহমান অসাধ্য সাধন করতে পারে। রহমানকে যদি বলা হয়— রহমান, তুমি যাও তো, সিংহের লেজটা দিয়ে কান চুলকে আসা। সে তা পারবে। সিংহ সেটা বুঝতেও পারবে না। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে–রহমান অসম্ভব ভীতু ধরনের ছেলে। এ জাতীয় দলে ভীতু ছেলেপুলে রাখাটা ঠিক না। কিন্তু রহমানকে রাখতে হয়েছে।
আলম খাট থেকে নামল। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে চায়ে চুমুক দিল। ঠাণ্ডা চা। সার পড়ে গিয়েছে। ঠাণ্ডার জন্যেই মিষ্টি বেশি লাগছে। বমি বমি ভাব এসে গেছে। সে আবার বিছানায় গিয়ে বসল। কিছু করবার নেই। এ বাড়ির ভদ্রমহিলা। গতকাল বিশাল এক উপন্যাস দিয়ে গেছেন। অচিন্তকুমার সেনগুপ্তের প্রথম কদম ফুল। প্রেমের উপন্যাস। প্রেম নিয়ে কেউ এত বড় একটা উপন্যাস ফাদতে পারে ভাবাই যায় না। কাকলী নামেব একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে একটি ছেলের। এই রকমই গল্প। কোনো সমস্যা নেই, কোনো ঝামেলা নেই–সুখের গল্প। পড়তে ভাল লাগছে না। তবু ছাপন্ন পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়া হয়েছে। আবার বইটি নিয়ে বসবে কিনা আলম মনস্থির করতে পারল না।