গরম করবার দরকার নেই। যেমন আছে দিন।
মতিন সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে উঠে গেলেন। একজন ক্ষুধার্তা মানুষের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে বকবক করছিলেন। খুব অন্যায়। খুবই অন্যায়।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটির প্রসঙ্গে সুরমা কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। যেন দেখবার পর তাঁর সব কৌতূহল মিটে গেছে। ভাত খাওয়ার সময় নিজেই দু’একটা বললেন। যেমন একবার বললেন, তুমি মনে হচ্ছে ঝাল কম খাও। ছেলেটি তার জবাবে অন্য এক রকম ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। দ্বিতীয়বারে বললেন, ছোট মাছ তুমি খেতে পারছি না দেখি। আস্তে আস্তে খাও, আমি একটা ডিম ভেজে নিয়ে আসি।
ছেলেটি এই কথায় খাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইল। ভাজা ডিমের জন্য প্রতীক্ষা। ব্যাপারটা মতিন সাহেবের বেশ মজার মনে হল। সাধারণত এই পরিস্থিতিতে সবাই বলে–না না লাগবে না। লাগবে না।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই বদিউল আলম বলল, আমাকে শোবার জায়গা দেখিয়ে দিন। মতিন সাহেব বললেন, এখুনি শোবে কী? বাস, কথাবার্তা বলি। স্বাধীন বাংলা বেতার শুনবে না?
জি না। স্বাধীন বাংলা বেতার শুনবার আমার কোন আগ্রহ নেই।
বল কী তুমি! কখনো শোন না?
শুনেছি মাঝে মাঝে।
তিনি খুই ক্ষুণ্ণ হলেন। ছেলেটি স্বাধীন বাংলা বেতার শোনে না সে কারণে নয়। ক্ষুণ্ণ হলেন কারণ খাওয়া শেষ করেই সে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। বলতে গেলে এ তার ছেলের বয়েসী। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের সামনে এ রকম ফাট করে সিগারেট ধরানো ঠিক না। তা ছাড়া ছেলেটি দুবার কথার মধ্যে তাকে বলেছে মতিন সাহেব। এ কী কাণ্ড! চাচা বলবে। যদি বলতে খারাপই লাগে কিছু বলবে না। কিন্তু মতিন সাহেব বলবে কেন? তিনি কী তার ইয়ার দোস্তদের কেউ? এ কেমন ব্যবহার?
ঘর ঠিকঠাক করলেন সুরমা। রাত্রি ও অপালার পাশের ছোট ঘরটায় ব্যবস্থা হল। বিন্তির ঘর। বিন্তি ঘুমুবে বারান্দায়। এ ঘরটা ভঁড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরিষ্কার করতে সময় লাগল। তবু পুরোপুরি পরিষ্কার হল না। চৌকির নিচে রসুন ও পেয়াজ। বস্তায় ভর্তি চাল-ডাল। এসব থেকে কেমন একটা টকটক গন্ধ ছড়াচ্ছে। সুরমা বললেন, তুমি এ ঘরে ঘুমুতে পারবে তো? না পারলে বল আমি বসার ঘরে ব্যবস্থা করে দেই। একটা ক্যাম্প খাট আছে। পেতে দিব।
লাগবে না।
বাথরুম কোথায় দেখে যাও।
বৈদিউল আলম বাথরুম দেখে এল।
কোনো কিছুর দরকার হলে আমাকে ডাকবে।
আমার কোনো কিছুর দরকার হবে না।
সুরমা চৌকির এক প্রান্তে বসলেন। বসার ভঙ্গিটা কঠিন। বদিউল আলম কৌতূহলী হয়ে তাকে দেখল।
আপনি কী আমাকে কিছু বলতে চান?
হ্যাঁ।
বলুন।
তুমি কে আমি জানি না। কোথেকে এসেছ তাও জানি না। কিন্তু কি জন্যে এসেছ তা আন্দাজ করতে পারি।
আন্দাজ করবার দরকার নেই। আমি বলছি কি জন্যে এসেছি। আপনাকে বলতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।
তোমার কিছু বলার দরকার নেই। আমি তোমাকে কি বলছি সেটা মন দিয়ে শোন।
বলুন।
তুমি সকালে উঠে এখান থেকে চলে যাবে।
ছেলেটি কিছু বলল না। তাঁর দিকে তাকালও না।
দু’টি মেয়ে নিয়ে আমি এখানে থাকি। কোনো রকম ঝামেলার মধ্যে আমি জড়াতে চাই না।
রাত্রির বাবা আমাকে না জিজ্ঞেস করে এসব করেছে। তুমি কী বুঝতে পারছি আমি কি বলতে চাচ্ছি?
পারছি।
তুমি কাল সকালে চলে যাবে।
কাল সকালে যাওয়া সম্ভব না। সব কিছু আগে থেকে ঠিকঠাক করা। মাঝখান থেকে হুঁট করে কিছু বদলানো যাবে না। আমি এক সপ্তাহ এখানে থাকব। আমার সঙ্গে যারা যোগাযোগ করবে: তারা এই ঠিকানাই জানে।
সুরমা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কি রকম উদ্ধত ভঙ্গিতে সে কথা বলছে। এ কি কাণ্ড!
তোমার জন্যে আমি আবার মেয়েগুলিকে নিয়ে বিপদে পড়ব? এসব তুমি কি বলছ?
বিপদে পড়বেন কেন? বিপদে পড়বেন না। এক সপ্তাহের মধ্যে আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে। এর পরের বার আমি এখানে উঠিব না। আর আপনার মেয়েরা তাদের ফুফুর বাড়িতে থাকুক। এক সপ্তাহ পর আসবে।
তুমি থাকবেই?
হ্যাঁ। অবশ্যি আপনি যদি ভয় দেখান আমাকে ধরিয়ে দেবেন, সেটা অন্য কথা। তা দেবেন। না। সেটা বুঝতে পারছি।
সুরমা উঠে দাঁড়ালেন। যে ছেলেটিকে এতক্ষণ লাজুক এবং বিনীত মনে হচ্ছিল এখন তাকে দুর্কিনীত অভদ্র একটি ছেলের মত লাগছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটির এই রূপটিই তার ভাল লাগল। কেন লাগল। তিনি বুঝতে পারলেন না।
আলম।
বলুন।
ঢাকা শহরে কী তোমার বাবা-মারা থাকেন?
হ্যাঁ থাকেন।
কোথায় থাকেন?
শহরেই থাকেন।
বলতে কী তোমার অসুবিধা আছে?
হ্যা আছে।
তুমি এক সপ্তাহ থাকবে?
হ্যাঁ।
সুরমা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। ঘন অন্ধকাবে নগরী ডুবে গেল। বুম বৃষ্টি নামল। সুরমা লক্ষ্য করলেন ছেলেটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। লাল আগুনের ফুলকি উঠানামা করছে।
মতিন সাহেব শোবার ঘরে ট্রানজিস্টার কানে লাগিয়ে বসে আছেন। ‘চরমপত্র’ শোনা যাচ্ছে। এটি তাকে দেখে যে-কেউ বলে দিতে পারবে। তিনি তীব্র কণ্ঠে কিছুক্ষণ পরপরই বলছেন, মার লেংগী। মার লেংগী শব্দটি তার নিজের তৈরি কিবা। একমাত্র চরমপত্র শোনার সময়ই তিনি এটা বলে থাকেন।
সুরমা মোমবাতি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই তিনি বললেন, কুমিল্লা সেক্টরে তো অবস্থা কেরোসিন করে দিয়েছে। লেংগী মেরে দিয়েছে বলেই খেয়াল হল। এই জাতীয় কথাবার্তা সুরমা সহ্য করতে পারে না। তিনি আশংকা করতে লাগলেন সুরমা কড়া কিছু বলবে। কিন্তু সে কিছুই বলল না।