যে লোকটি আশফাকের ডান হাত নিজের মুঠোয় ধরে রেখেছে তার মুখ গোলাকার। এ রকম গোল মানুষের মুখ হয়? যেন কম্পাস দিয়ে মুখটি আঁকা। তার হাতটিও মেয়েদের হাতের মত তুলতুলে নরম। লোকটি পেনসিলের মত সাইজের একটি কাঠি। আশফাকের দুআঙুলের ফাকে রাখল। আশফাকের মনে হচ্ছে এটা একটা স্বপ্নদৃশ্য। বাস্তবে এ রকম কিছু ঘটছে না। গোলাকার মুখের এ লোকটি তার হাত নিয়ে খেলা করছে। আশফাক নিজেই বুঝতে পারল না যে সে পশুর মত আঁ আঁ করে চিৎকার করে উঠেছে। কেউ কী টেনে তার হাতটি ছিঁড়ে ফেলেছে? কী করছে এরা? কী করছে? তীব্র তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। দ্বিতীয়বারের মত চিৎকার করেই সে জ্ঞান হারাল।
মেজর রাকিব তাকিয়ে আছে তার দিকে। কি সুন্দর চেহারা এই লোকটির! নাদিমের সঙ্গে মিল আছে। নাকটা লম্বা।
আশফাক, তোমার জ্ঞান ফিরেছে মনে হচ্ছে। ভালই হয়েছে। গাড়ি এসে গেছে। চল, যাওয়া যাক। নাকি যাবার আগে আরেক কাপ কফি খাবে?
আশফাক তাকিয়ে আছে। লোকটি নাদিমের মত লম্বা নয়। একটু খাট। বড়জোর পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি।
আশফাক, তুমি ওদের ঠিকানা জান নিশ্চয়ই। জানি না?
কয়েকজনের জানি। সবার জানি না।
ওতেই হবে। ব্যাপারটা হচ্ছে মাকড়সার জালের মত। একটা সুতার সন্ধান পাওয়া গেলে জালটা খুঁজে পাওয়া যায়। আশফাক।
বলুন!
চল, রওনা হওয়া যাক।
আমি আপনাকে কিছুই বলব না।
কিছুই বলবে না?
না।
মাত্র দু’টি আঙুল তোমার ভাঙা হয়েছে। তোমার হাতে আরো আটটি আঙুল আছে।
আমি কিছুই বলব না।
তোমার মাথা গরম হয়ে গেছে। অনেক সময় ব্যথার পরিমাণ বেশি হলে মাথা গরম হয়ে যায়। তুমি মাথা ঠাণ্ডা কর। কফি খাও, সিগারেট খাও। তারপর আমরা কথা বলব। নাকি সলিড় কিছু খাবে? গোশত পরোটা?
আশফাক কিছু বলল না। সে তাকিয়ে আছে তার বা হাতের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে কেমন ফুলে উঠেছে। একি সত্যি তার হাত?
আশফাক গোশত, পরটা খুব আগ্রহ করে খেল। তার এতটা ক্ষিধে পেয়েছিল সে নিজেও বুঝতে পারেনি। ঝাল দিয়ে রান্না করা গোশত। চমৎকার লাগছে। পশ্চিমারা এতটা ঝাল খায় তার জানা ছিল না।
আশফাক!
জি।
আরো লাগবে?
জি না।
কফি চলবে?
একটা পান খাব।
পান খাওয়া যাবে না। দোকানপাট বন্ধ। এখন কার্ফু চলছে। সিগারেট আছে তো? না থাকলে বল।
জি আছে।
চল, তাহলে রওনা দেওয়া যাক।
কোথায়?
তুমি তোমার বন্ধুদের দেখিয়ে দেবে। বাড়ি চিনিয়ে দেবে।
আশফাক অনেক কষ্টে এক হাতে দেয়াশলাই জ্বলিয়ে সিগারেট ধরাল। অনেকখানি সময় নিয়ে ধোয়া ছাড়ল। বেশ লাগছে সিগারেট।
মেজর সাহেব।
বল।
আমি কিছুই বলব না।
কিছুই বলবে না?
জি না। আপনি তো আমাকে মেরেই ফেলবেন। মারেন। কষ্ট দেবেন না। কষ্ট দেয়া ঠিক না।
মরতে ভয় পাও না?
জি পাই। কিন্তু কি করব বলেন। উপায় কি?
উপায় আছে। ধরিয়ে দাও ওদের। আমি তোমাকে ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করব। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই গ্যারান্টি তোমাকে দিচ্ছি।
মেজর সাহেব, এটা সম্ভব না।
সম্ভব না?
জি না। আমি তো মানুষের বাচ্চা। কুকুর বিড়ালের বাচ্চা তো না।
তুমি মানুষের বাচ্চা?
জি, আমাকে কষ্ট দেবেন না মেজর সাহেব। মেরে ফেলতে বলেন। কষ্ট সহ্য করতে পারি না।
মেজর রাকিব। দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইল। এই ছেলেটির যাবতীয় যন্ত্রণার অবসান করবার জন্যে তার ইচ্ছা করছে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। খবর বের করতেই হবে। এটা একটা মাকড়সার জাল। একটা সুতা পাওয়া গেছে। জালটিও পাওয়া যাবে। যেতেই হবে। মানুষ আসলে একটি দুর্বল প্ৰাণী। মেজর রাকিব আশফাকের আরো দু’টি আঙুল ভেঙে ফেলার হুঁকুম দিয়ে নিজের ঘরে এসে বসল।
বাইরে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে।
রাত এগারোটায় টেলিফোন। নাসিমা ভয়ে ভয়ে টেলিফোন ধরলেন।
কে?
ফুফু, আমি।
কী ব্যাপার রাত্রি? গলা এরকম শুনাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?
কিছু হয়নি। ফুফু, তোমার কাছে যে একজন ভদ্রমহিলা এসেছিলেন। মেডিকেল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর মিসেস রাবেয়া করিম, উনার টেলিফোন নম্বর দাও।
কেন?
খুব দরকার ফুফু। তুমি দাও।
কী হয়েছে বলা?
বলছি। নম্বরটা দাও আগে। তোমার পায়ে পড়ি ফুফু।
নাসিমা অবাক হয়ে শুনলেন রাত্ৰি ফুপিয়ে কাঁদছে। তিনি নম্বর এনে দিলেন।
সেই নম্বরে বারবার টেলিফোন করেও কাউকে পাওয়া গেল না। রিং হচ্ছে, কেউ ধরছে না।
মতিন সাহেব ঠিক একই ভঙ্গিতে কাঁধ চেপে ধরে আছেন। তার ধারণা রক্ত বন্ধ হয়েছে। তিনি মনে মনে সারাক্ষণ সুরা এখলাস পড়ছেন।
আলম এখন আর পানি খেতে চাচ্ছে না। খানিকটা আচ্ছন্নের মত হয়ে পড়েছে। সুরমা এক কাঁপা গরম দুধ খাওয়াতে চেষ্টা করলেন। এটা সে খেতে পারল বলে মনে হল।
তার জ্ঞান আছে। ডাকলে সাড়া দেয়। চোখ মেলে তাকায়। সেই চোখ টকটকে লাল।
মতিন সাহেব বললেন, মাথায় জলপট্টি দেয়া দরকার। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সুরমা ভেজা তোয়ালে নিয়ে এস।
ভেজা তোয়ালে দিয়ে কপাল স্পর্শ করতেই আলম কেঁপে উঠল। সুরমা মৃদু স্বরে বললেন, বাবা, এখন রাত দুটো বাজে। ভোর হতে বেশি বাকি নেই। ভোর হলেই যে ভাবেই হোক তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। তুমি শক্ত থাক।
আশফাক তাকিয়ে আছে। শূন্য দৃষ্টিতে। মেজর রাকিবের মুখ এমন গোলাকার লাগছে কেন? তার মুখ তো এমন ছিল না। গোল মুখ ছিল ঐ লোকটির যে আঙুল ভাঙে। ভাঙার সময় কেমন টুক করে শব্দ হয়।
আশফাক।
জি।
চিনতে পারছ আমাকে?
জি। আপনি মেজর রাকিব।