যখন ঘুম ভাঙল তখন চারদিক অন্ধকার। টিপটপ বৃষ্টি পড়ছে। দমকা বাতাস দিচ্ছে। তিনি খোঁজ নিলেন–কেউ এসেছে কী-না। কেউ আসেনি। কার্ফু শুরু হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। এখন আব আসার সময় নেই। কাল কি আসবে? বোধহয় না। শুধু শুধুই অপেক্ষা করা হল। তিনি শোবার ঘরে উঁকি দিলেন। সুরমা ঘুমুচ্ছে। একটা সাদা চাদরে তার শরীর ঢাকা। তাকে কেমন অসহায় দেখাচ্ছে। মতিন সাহেব কোমল গলায় ডাকলেন, সুরমা সুরমা। সুরমা পােশ ফিরলেন।
ঘড়িতে সাড়ে পাঁচ বাজে। কার্ফু শুরু হতে এখনো আধা ঘণ্টা বাকি। কিন্তু এর মধ্যেই চারদিক জনশূন্য। লোকজন যার যার বাড়ি ফিরে গেছে। বাকি রাতটায় আর ঘর থেকে বেরুবে না। ইদ্রিস মিয়া তার দোকান বন্ধ করার জন্যে উঠে দাঁড়াল। রোজ শেষ মুহূর্তে কিছু বিক্রিবাটা হয়। আজ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না কে জানে? অন্ধকার দেখে সবাই ভাবছে বোধ হয়। কার্ফুর সময় হয়ে গেছে। সময় না হলেও কিছু যায় আসে না। আজকাল সবাই অন্ধকারকে ভয় পায়। ইদ্রিস মিয়া দোকানের তালা লাগাবার সময় লক্ষ্য করল গলির ভেতরে লম্বা একটি ছেলে ঢুকছে। তার হাতে কয়েকটা পত্রিকা। হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বাসার নম্বর পড়তে পড়তে আসছে। ইদ্রিস মিয়ার দোকানের সামনে এসে সে থমকে দাঁড়াল। ইদ্রিস মিয়া বলল, আপনি কী মতিন সাহেবের বাড়ি খুঁজছেন?
ছেলেটি তাকাল বিস্মিত হয়ে। কিছু বলল না। ইদ্রিস বাড়ি দেখিয়ে দিল। নিচু গলায় বলল, লোহার গেইট আছে। গেটের কাছে একটা নারকেল গাছ। তাড়াতাড়ি যান। ছাঁটার সময় কাফু।
ইন্দ্রিস মিয়া হন।হন করে হাঁটতে লাগল। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না। ছেলেটি তাকিয়ে রইল ইদ্রিস মিয়ার দিকে। লোকটি ছোটখাট। প্রায় দৌড়াচ্ছে। সে নিশ্চয়ই অনেকখানি দূরে থাকে। ছটার আগে তাকে পৌঁছতে হবে।
ছেলেটি এগিয়ে গেল। লোহার গেটের বাড়িটির সামনে দাঁড়াল। নারকেল গাছ দু’টি বন্ধুকে আছে রাস্তার দিকে। প্রচুর নারকেল হয়েছে। ফলের ভরে যেন গাছ হেলে আছে। দেখতে বড় ভাল লাগে। ছেলেটি গেটে টোকা দিয়ে ভারী গলায় ডাকল, মতিন সাহেব, মতিনউদ্দিন সাহেব। বয়সের তুলনায় তার গলা ভারী। ছেলেটির নাম বদিউল আলম। তিন মাস পর সে এই প্রথম ঢুকেছে ঢাকা শহরে।
জুলাই মাসের ছ’ তারিখ। বুধবার। উনিশ শো একাত্তুর সন। একটি ভয়াবহ বছর। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর কঠিন মুঠির ভেতরে একটি অসহায় শহর। শহরের অসহায় মানুষ। চারদিকে সীমাহীন অন্ধকার। সীমাহীন ক্লান্তি। দীর্ঘ দিবস এবং দীর্ঘ রজনী।
বদিউল আলম গেট ধরে দাঁড়িয়েছে। সে শহরে ঢুকেছে সাতজনের একটি ছোট্ট দল নিয়ে। শহরে গেরিলা অপারেশন চালানোর দায়িত্ব তার। ছেলেটি রোগ। চশমায় ঢাকা বড় বড় চোখ। গায়ে হালকা নীল রঙের হাওয়াই শার্ট। সে একটি রুমাল বের করে কপাল মুছে দ্বিতীয়বার ডাকল, মতিন সাহেব! মতিন সাহেব!
মতিন সাহেব দরজা খুলে বের হলেন। দীর্ঘ সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ছেলেটির দিকে। এ তো নিতান্তই বাচ্চা ছেলে। এরই কী আসার কথা?
আমার নাম বদিউল আলম।
আস বাবা, ভেতরে আস।
এই সামান্য কথা বলতে গিয়ে মতিন সাহেবের গলা ধরে গেল। চোখ ভিজে উঠল। এত আনন্দ হচ্ছে! তিনি চাপা স্বরে বললেন, কেমন আছ তুমি?
ভাল আছি।
সঙ্গে জিনিসপত্র কিছু নেই?
না।
বল কী!
সুরমা দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। পর্দা সরিয়ে তাকিয়ে আছেন। মতিন সাহেব বললেন, আস, ভেতরে আস। দাঁড়িয়ে আছে কেন?
গোটটা বন্ধ। গেট খুলুন।
ও আচ্ছা আচ্ছা।
মতিন সাহেব সংকুচিত হয়ে পড়লেন। সাড়ে পাঁচটার দিকে গেটে তালা দিয়ে দেয়া হয়।
চাবি থাকে সুরমার কাছে। সুরমা আঁচল থেকে চাবি বের করলেন। গেটে তালা দিয়ে রাখি। আগে দিতাম না। এখন দেই। অবশ্যি চুরি-ডাকাতির ভয়ে না। চুরি-ডাকাতি কমে গেছে। চোরডাকাতরা এখন কিভাবে বেঁচে আছে কে জানে। বোধ হয় কষ্টে আছে।
বদিউল আলম বসবার ঘরে ঢুকল। মতিন সাহেবের মনে হল এই ছেলেটির কোনো দিকেই কোনো উৎসাহ নেই। সোফাতে বসে আছে কিন্তু কোনো কিছু দেখছে না। বসার ভঙ্গির মধ্যেই গাছেড়ে-দেয়া ভাব আছে। মতিন সাহেব নিজের মনের কথা বলে যেতে লাগলেন, কয়েকদিন ধরে আমরা স্বামী-স্ত্রী আছি। এই বাড়িতে। আমাদের দুই মেয়ে আছে–রাত্রি আর অপালা। ওরা তার ফুফুর বাড়িতে। সোমবারে আসবে। ওদের ফুফু, মানে আমার বোনের কোন ছেলেপুলে নেই। মাঝে-মধ্যে রাত্রি আর অপালাকে নিয়ে যায়। ওরাও তাদের ফুফুর খুব ভক্ত। খুবই ভক্ত।
বদিউল আলম কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল। মতিন সাহেব খানিকটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। গলা পরিষ্কার করে বললেন – অবস্থা কি বল শুনি।
কিসের অবস্থা?
তোমরা যেখানে ছিলে সেখানকার অবস্থা।
ভালই।
আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বাঘের পেটের ভেতর আছি। কাজেই বাঘটা কী করছে না করছে বোঝার উপায় নেই। বাঘ মারা না পড়া পর্যন্ত কিছুই বুঝব না। মারা পড়ার পরই পেট থেকে বের হব।
মতিন সাহেবের এটা একটি প্রিয় ডায়ালগ। সুযোগ পেলেই এটা ব্যবহার করেন। শ্রোতারা তখন বেশ উৎসাহী হয়ে তাকায়। কয়েকজন বলেই ফেলে–ভাল বলেছেন। কিন্তু এবারে সে রকম কিছু হল না। মতিন সাহেবের ভয় হল ছেলেটা হয়ত শুনছেই না।
তুমি হাত-মুখ ধুয়ে আসা। চায়ের ব্যবস্থা করছি।
চা খাব না। ভাতের ব্যবস্থা করুন, যদি অসুবিধা না হয়।
না না, অসুবিধা কিসের? কোনো অসুবিধা নেই। খাবার-টাবার গরম করতে বলে দেই।