অপালা ফিসফিস করে বলল, আপা উনি কি মারা গেছেন?
না, মারা যাবেন কেন? ভাল আছেন।
তাহলে কোনো কথাবার্তা শুনছি না কেন?
রাত্রি কোনো জবাব দিল না। অপালা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তুমি একটু আমার পাশে বসে। থাক আপা। রাত্রি বসল। ঠিক তখনি শুনতে পেল আলম আবার তার মাকে ডাকছে আমি আম্মি।
রাত্রি উঠে দাঁড়াল।
সুরমা হারিকেন জ্বলিয়ে রান্নাঘরেই বসে আছেন। রাত্রি ছায়ার মত রান্নাঘরে এসে ঢুকল। কাঁপা গলায় বলল, মা, তুমি উনার হাত ধরে একটু বসে থাক। উনি বারবার তার মাকে ডাকছেন।
সুরমা নড়লেন না। হারিকেনের দিকে তাকিয়ে বসেই রইলেন। রাত্রি বলল, মা এখন আমরা কি করব?
সুরমা ফিসফিস করে বললেন, কিছু বুঝতে পারছি না।
হাওয়ার ঝাপটায় হারিকেনের আলো কাপছে। বিচিত্র সব নকশা তৈরি হচ্ছে দেয়ালে। প্রচণ্ড শব্দে কাছেই কোথাও যেন বাজ পড়ল। মতিন সাহেব ও-ঘর থেকে চেঁচাচ্ছেন – আলো দিয়ে যাচ্ছ না কেন? হয়েছে কি সবার? ভয় পেয়ে অপালা তার ঘরে কাঁদতে শুরু করেছে। কি ভয়ংকর একটি রাত। কি ভয়ংকর!
গত দেড় ঘণ্টা যাবত আশফাক একটা চেয়ারে জড়সড় হয়ে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার কোনো বোধশক্তি নেই। চারপাশে কোথায় কি ঘটছে। সে সম্পর্কেও কোনো আগ্রহ নেই। তার সামনে একজন মিলিটারি অফিসার বসে আছেন। অফিসারটির গায়ে কোন ইউনিফর্ম নেই। লম্বা কোর্তার মত একটা পোশাক। ইউনিফর্ম না থাকায় তার র্যাংক বোঝা যাচ্ছে না। বয়স দেখে মনে হয় মেজর কিংবা ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল। জুলপির কাছে কিছু চুল পাকা।
চেহারা রাজপুত্রের মত। কথা বলে নিচু গলায়। খুব কফি খাওয়ার অভ্যেস। আশফাক লক্ষ্য করছে এই এক ঘণ্টায় সে ছয় কাঁপের মত কফি খেয়েছে। কফি খাওয়ার ধরনটিও বিচিত্র। কয়েক চুমুক দিয়ে রেখে দিচ্ছে। এবং নতুন আরেক কাপ দিতে বলছে। এখন পর্যন্ত আশফাকের সাথে তার কোনো কথা হয়নি। আশফাক বসে আছে। অফিসারটি কফিতে চুমুক দিচ্ছে এবং নিজের মনে কি সব লেখালেখি করছে। মনে হচ্ছে। আশফাক সম্পর্কে তার কোনো উৎসাহ নেই।
ঘরটি খুবই ছোট। তবে মেঝেতে কার্পেট আছে। দরজায় ফুল তোলা পর্দা। অফিস ঘরের জন্যে পর্দাগুলি মানাচ্ছে না। কার্পেটের রঙের সঙ্গেও মিশ খাচ্ছে না। কাঁপেট লাল রঙের, পর্দা দু’টি নীল। আশফাক বসে বসে পর্দায় কতগুলি ফুল আছে তা গোণার চেষ্টা করছে। তার প্রচণ্ড সিগারেটের তৃষ্ণা হচ্ছে। সিগারেট আছে সঙ্গে, তবে ধরাবার সাহস হচ্ছে না।
মিলিটারি অফিসারটির কাজ মনে হয় শেষ হয়েছে। সে ফাইল পত্র একপাশে সরিয়ে রেখে আশফাকের দিকে তাকিয়ে চমৎকার ইংরেজিতে বলল, কফি খাবে? ঝড়বৃষ্টিতে কফি ভালই লাগবে।
আশফাক কোনো উত্তর দিল না।
আশফাক তোমার নাম?
হ্যাঁ।
তোমার গাড়িতে যে দু’টি ডেড বডি পাওয়া গেছে। ওদের নাম কি?
আশফাক নাম বলল। অফিসারটির মনে হল নামের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই। সে হাই তুলে উঁচু গলায় দুকাপ কফি দিতে বলল। কফি চলে এল সঙ্গে সঙ্গেই।
খাও, কফি খাও। আমার নাম রাকিব। মেজর রাকিব। আমি কফিতে দুধ চিনি খাই না। তোমারটাতেও দুধ চিনি নেই। লাগলে বলবে। তুমি সিগারেট খাও?
হ্যাঁ।
তাহলে সিগারেট ধরাও। স্মোকাররা সিগারেট ছাড়া কফি খেতে পারে না।
আশফাক কফিতে চুমুক দিল। চমৎকার কফি। সিগারেট ধরাল। ভাল লাগছে সিগারেট টানতে। মেজর রাকিব তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। তার চোখ দু’টি হাসি হাসি।
আশফাক।
বলুন।
আমরা দু’জন পনেরো মিনিটের মধ্যে এখান থেকে বেরুব। ঝড়টা কমার জন্যে অপেক্ষা করছি। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে এবং তোমার সহকর্মীরা যেসব জায়গায় থাকে। সেসব আমাদের দেখিয়ে দেবে। আমরা আজ রাতের মধ্যেই সবাইকে ধরে ফেলব।
আশফাক তাকিয়ে রইল।
তোমার সাহায্য আমি মনে রাখব। এইটুকু শুধু তোমাকে বলছি।
আশফাক নিচু গলায় বলল, ওরা কোথায় থাকে আমি জানি না। মেজর রাকিব। এমন ভাব করল যে সে এই কথাটি শুনতে পায়নি। হাসি হাসি মুখে বলল, কেউ কথা না বলতে চাইলে আমাদের বেশ কিছু পদ্ধতি আছে। কিছু কিছু পদ্ধতি বেশ মজার। একটা তোমাকে বলি। এক বুড়োকে আমরা ধরলাম গত সপ্তাহে। আমার ধারণা হল সে কিছু খবরাখবর জানে। ভাব দেখে মনে হল কিছু বলবে না। আমি তখন ওর মেয়েটিকে ধরে আনলাম এবং বললাম, মুখ না খুললে আমার একজন জোয়ান তোমার সামনে মেয়েটিকে রেপ করবে। পাঁচ মিনিট সময়। এর মধ্যে ঠিক কর বলবে কি বলবে না। বুড়ো এক মিনিটের মাথায় কথা বলতে শুরু করল।
আশফাক বলল, স্যার আমি কারোরই ঠিকানা জানি না।
এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
এরা আমার কাছে এসেছে, আমি ওদের গাড়ি করে নিয়ে গিয়েছি। আমি নিজেও মুক্তিযোদ্ধা না।
ওরা তোমাকে জোর করে নিয়ে গেছে, তাই না? গান পয়েন্টে না গেলে তোমাকে ওরা গুলি করে মেরে ফেলত?
জি।
নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে তুমি এই কাজটি করেছ।
জি স্যার।
তা তো করবেই। গান পয়েন্টে কেউ কিছু বললে না। শুনে উপায় নেই। শুনতেই হয়।
মেজর রাকিব আরেক কাপ কফির কথা বলল। কফি নিয়ে যে লোকটি ঢুকাল তাকে বলল, তুমি একে নিয়ে যাও। ওর দু’টি আঙুল ভেঙে আমার কাছে নিয়ে আসা। বেশি ব্যথা দিও না।
রাকিব হাসিমুখে তাকাল আশফাকের দিকে এবং নরম গলায় বলল, তুমি ওর সঙ্গে যাও। এবং শুনে রাখা এখন বাজে নটা কুড়ি, তুমি নটা পঁয়ত্ৰিশ মিনিটে প্রচুর কথা বলবে। সবার বাড়ি দেখিয়ে দেবে। ধরিয়ে দেবে। আমি এই নিয়ে তোমার সঙ্গে দশ হাজার টাকা বাজি রাখতে পারি।