আশফাকের গাড়ি লাফিয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে উড়ে চলে যাবে। নূরু দু’টি গ্রেনেডই ছুড়েছে। বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়ার আগেই ওদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে পড়ল। আলম নিজের স্টেনগানের উপর ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল–মাথা ঠাণ্ডা রাখ, মাথা ঠাণ্ডা।
শরীফ সাহেব বাড়ি ফিরবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলেন। তখন খবরটা পেলেন। মিলিটারিদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ হয়েছে গেরিলাদের। গেরিলাদের কিছুই হয়নি। কিন্তু মিলিটারিদের একটা ট্রাক উড়ে গেছে। এ জাতীয় খবর কখনো পুরোপুরি সত্যি হয় না। উইসফুল থিংকিংয়ের একটা ব্যাপার আছে। বাস্তবে নিশ্চয়ই অন্যরকম কিছু হয়েছে। গেরিলাদের গায়ে আঁচড়ও পড়বে না তা কি হয়!
শরীফ সাহেব খুব আশা করতে লাগলেন যেন সংঘর্ষের খবরটা সত্যি না হয়। সত্যি না হবার কথা। দিনে দুপুরে ওরা কি মিলিটারিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়বে? অবশ্যি পড়তেও পারে। রোমান্টিসিজম! ওদের যা বয়স তাতে রোমান্টিসিজমই প্ৰাধান্য পাবে। এ জাতীয় অপারেশনে আসা উচিত মধ্য বয়স্কদের। যারা সাবধানী।
তিনি বাড়ি ফিরে কাপড় না ছেড়েই বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে রইলেন। আলমের জন্যে অপেক্ষা। সে আসছে না; দেরি করছে কেন? খোঁজখবর নেবারও কোনো উপায় নেই। কে কোথায় থাকে তার জানা নেই। সাবধানতা! যেখানে ওদের সাবধানী হওয়া উচিত। সেখানে না হয়ে অন্য জায়গায়। কোন মানে হয়?
দুপুর তিনটায় নিয়ামত সাহেব টেলিফোন করলেন।
খবর শুনছেন? ভেরি অথেনটিক।
কি খবর?
গেরিলাদের একটা পিকআপ ধরা পড়েছে। দুজনের ডেড বডি পাওয়া গেছে।
কে বলেছে আপনাকে? যত উড়ো খবর। এইসব খবরে কান দেবেন না। এবং টেলিফোনে এসব ডিসকাসও করবেন না।
শরীফ সাহেব টেলিফোন নামিয়ে আবার বারান্দায় এসে বসলেন।
মতিন সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন একটা বেবি টেক্সি এসে তার বাড়ির সামনে থেমেছে। বেবি টেক্সি ড্রাইভার এবং একটি অচেনা লোক আলমকে ধরাধরি করে নামাচ্ছে। তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, কি হয়েছে? অপরিচিত লম্বা ছেলেটি বলল, গুলি লেগেছে। আপনারা রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করুন। আমি ডাক্তার নিয়ে আসব। আমার নাম আশফাক। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। এসে ধরুন।
তারা বসার ঘরে ঢুকল। আলমের জ্ঞান আছে। সে হাত দিয়ে বাঁ কাঁধ চেপে ধরে আছে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে সেখান থেকে।
রাত্রি এসে দাঁড়িয়েছে। দরজার পাশে। তার মুখ রক্তশূন্য। সে একটি কথাও বলছে না। মতিন সাহেব ভাঙা গলায় বললেন, মা একে ধর। রাত্রি নড়ল না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।
ভেতর থেকে সেলাই মেশিনের শব্দ হচ্ছে। আশফাক শান্ত স্বরে বলল, আলম ভাই, আপনি কোনো রকম চিন্তা করবেন না। কারফিউয়ের আগেই আমি ডাক্তারের ব্যবস্থা করব। যেভাবেই হোক।
বেবিটেক্সির বুড়ো ড্রাইভারটির মুখ ভাবলেশহীন। যেন এ জাতীয় ঘটনা সে জীবনে বহু দেখেছে।
আশফাক তার ঘরে পৌঁছল পাঁচটায়। এখান থেকে সে যাবে ঝিকাতলা। ওদের খবর দিয়ে ডাক্তারের ব্যবস্থা করতে হবে। কাৰ্য্য শুরু হয়ে যাবে সাড়ে ছটায়। হাতে অনেকখানি সময়।
সে গেঞ্জি বদলে একটা শার্ট পরল। অভ্যাস বসে চুল আচড়াল, নিচে নামল। গালে ক্রিম দিল। মুখের চামড়া টানছে। এসব শীতকালে হয়। চামড়া শুকিয়ে যায়। কিন্তু তার এখন হচ্ছে কেন? বড়ড ক্লান্ত লাগছে। নিচে নামতে গিয়ে পা কাপছে। কেন এ রকম হচ্ছে? সে এখনো বেঁচে আছে। বিরাট ঘটনা। আনন্দে চিৎকার করা উচিত। কিন্তু আনন্দ হচ্ছে না। কেমন যেন ঘুম ाgbछ।
তার জন্যে কালো রঙের জিপ নিয়ে আমি ইন্টেলিজেন্সের লোকজন অপেক্ষা করছে।
আশফাক তোমার নাম?
হ্যাঁ!
চল আমাদের সঙ্গে; তোমার জন্য গত এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি।
জোনাকি
রাত্রি পাথরের মূর্তির মত একা একা বসার ঘরে বসে আছে। দুপুর থেকেই আকাশ মেঘে মেঘে কালো হয়েছিল। এখন বৃষ্টি নামল। প্রবল বর্ষণ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘনঘন বাজ পড়ছে।
রাস্তায় লোক চলাচল একেবারেই নেই। দু’একটা রিকশা বা বেবিটেক্সির শব্দ শোনামাত্র রাত্রি বের হয়ে আসছে। বোধ হয় ডাক্তার নিয়ে কেউ এসেছে। না কেউ না। কাৰ্য্যর সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর হয়ত একটি রিকশা বা বেবিটেক্সির শব্দ কানে আসবে না। দ্রুতগামী জিপ কিংবা ভারী ট্রাকের শব্দ কানে আসবে। রাত্রি ঘড়ি দেখে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সামনের পুকুরে এই অবেলায় একজন লোক গোসল করছে। কোথাও কেউ নেই। এমন ঘোর বর্ষণ-এর ভেতর নিজের মনে লোকটা সাঁতার কাটছে। দেখে মনে হচ্ছে এই লোকটির মনে কত আনন্দ।
জামগাছওয়ালা বাড়ির উকিল সাহেব বাজার নিয়ে ফিরছিলেন। তার এক হাতে ছাতি, তবু তিনি পুরোপুরি ভিজে গেছেন। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে রাত্রিকে দেখলেন। অবাক হয়ে বুললেন, একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছ কেন মা? ভেতরে যাও। কখনো বারান্দায় থাকবে না। যাও যাও, ভেতরে যাও। দরজা বন্ধ করে দাও।
রাত্রি বলল, কার্ফু কি শুরু হয়েছে চাচা?
না, এখনো ঘণ্টা খানিক আছে। যাও মা, ভেতরে যাও।
উকিল সাহেব লম্বা লম্বা পা ফেলে এগুলেন। তার এক মেয়ে যুথী রাত্রির সঙ্গে পড়ত। মেট্রিক পাস করবার পরই তার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের এক বছরের মাথায় বাচ্চা হতে গিয়ে যুথী মারা গেল। বিয়ে না হলে মেয়েটা বেঁচে থাকত। মেয়েদের জীবন বড় কষ্টের।
লোকটা পুকুরে এখনো সাঁতার কাটছে। চিৎ হয়ে, কান্ত হয়ে নানান রকম ভঙ্গি করছে। পাগল নাকি?