সুরমা নাস্তা টেবিলে দিয়ে আলমকে ডাকতে এলেন। আলম জুতো পরছে।
কোথাও বেরুচ্ছ?
জি।
কখন ফিরবে?
বিকেলে এসে বিদায় নিয়ে যাব।
সুরমা একবার ভাবলেন বলেন, মাঝে মাঝে এসো। কিন্তু বলতে পারলেন না। যেসব কথা আমরা বলতে চাই তার বেশির ভাগই আমরা বলতে পারি না।
নাশতা খেতে আস বাবা।
আসছি।
মতিন সাহেব ঢাকা রেডিও খুলে বসেছিলেন। বাচ্চাদের একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। কিচিরমিচির করছে একদল বাচা।
আপা, আমি একটা ছড়া বলব। আমার নাম রুমান ময়না। ময়না কোন কথা কয় না…
বাহ বাহ বেশ হয়েছে। এবার তুমি আস। পরিষ্কার করে নাম বল।
আপা, আমার নাম সুমন, আমি একটা গান গাইব। রচনা বিদ্রোহী কবি নজরুল– কাবেরী নদীজলে কে গো বালিকা…
চমৎকার হয়েছে। এবার তুমি আস।
মতিন সাহেব বিড়বিড় করে বললেন… এদের ধরে চাবকান উচিত। এ সময় গান গাচ্ছে, ছড়া বলছে, কতবড় স্পর্ধা!
সুরমা এসে বললেন, নাশতা দেয়া হয়েছে। খেতে আস।
মতিন সাহেব শিশুর মত রেগে গেলেন।
যাও, আমি খাব না কিছু। যত ইডিয়টের দল। গান গাইছে, ছড়া বলছে। চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিতে হয়।
শরীফ সাহেব আলমকে দেখে মোটেই অবাক হলেন না। তার ভঙ্গি দেখে মনে হল তিনি যেন মনে মনে তার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন।
মামা কি খবর তোমার?
ভাল। তুই এখনো বেঁচে আছিস?
আছি।
কাল রাতে স্বপ্নে দেখলাম গুলি খেয়েছিস; তখনি বুঝলাম তুই ভাল আছিস। আমার স্বপ্ন সব সময় উল্টো হয়।
শরীফ সাহেব কোমরের লুঙ্গি আঁট করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন। নটা বাজে। অফিসে যাবার জন্য তৈরি হতে হয়। কিন্তু কেন যেন অফিসে যেতে ইচ্ছা করছে না। লুঙ্গিী বদলে প্যান্ট পরতে হবে ভাবতেই খারাপ লাগছে।
চা খাবি?
না।
কফি। কফি খাবি? একটা ইনসটেন্ট কফি কিনেছি। চা বানানোর মহা হাঙ্গামা। কাজের ছেলেটা আমার একটা সুটকেস নিয়ে পালিয়ে গেছে।
বলতে বলতে তাঁর হাসি পেয়ে গেল। কারণ সুটকেসটিতে কিছু পুরনো ম্যাগাজিন ছাড়া কিছু ছিল না। ছাত্র জীবনে কিছু গল্প কবিতা লিখতেন। তার কয়েকটি ছাপাও হয়েছিল। সুটকেস বোঝাই সেই সব ম্যাগাজিনে। ·
হাসছ কেন?
ব্যাটা খুব ঠক খেয়েছে। সুটকেস খুলে হাউমাই করে কাঁদবে।
আলমের মনে হল, তার মামার হাসির ভঙ্গিটি কেমন যেন অস্বভাবিক। সুস্থ মানুষের হাসি নয়। অসুস্থ মানুষের হাসি।
আলম।
বল।
তোর চিঠি তোর মাকে পৌঁছে দিয়েছি।
মা ভাল আছেন?
জানি না।
জানি না মানে?
দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।
ভাল করেছ। ভাবছি নিজেও চলে যাব। রাতে ঘুম হয় না।
যাও, চলে যাও।
কিন্তু ওরা খুঁজে বের করে ফেলবে। ফখরুদ্দীন সাহেব পালিয়ে গিয়েছিলেন। মানিকগঞ্জ তার শ্বশুরবাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসেছে। এখন বোধ হয় মেরেই ফেলেছে। খাবি তুই কফি?
দাও।
ফার্মগেটের অপারেশনে তুই ছিলি?
হুঁ।
ভালই দেখিয়েছিস।
আলম হাসল। হাসিমুখে বলল, তোমার সামনে সিগারেট খেলে তুমি রাগ করবে?
খেতে ইচ্ছা হলে খা। লায়েক হয়ে গেছিস, এখন তো খাবিই।
কফি ভাল হল না। অতিরিক্ত কড়া হয়ে গেল। হালকা করার জন্য দুধ ও গরম পানি মেশানোর পর তার স্বাদ হল আরো কুৎসিত। শরীফ সাহেব খুব বিকৃত করে বললেন, পেচ্ছাবের মত লাগছে। ফেলে দে। আবার বানাব।
আর বানাতে হবে না। মামা একটা কথা শোন।
বল, শুনছি।
আমি যদি তোমার এখানে থাকি কয়েকদিন তোমার অসুবিধা হবে?
না। আগে যেখানে ছিলি সেখানে কি অবস্থা? জানাজানি হয়ে গেছে?
তা না। ভদ্রমহিলা একটু ভয় পাচ্ছেন। তাছাড়া আমি বলেছিলাম এক সপ্তাহ থাকিব। এক সপ্তাহ হয়ে গেছে।
কখন আসবি?
বিকেলে। আমাকে একটা চাবি দাও।
শরীফ সাহেব চাবি বের করে দিলেন। এবং দ্রুত কাপড় পরতে শুরু করলেন। আলম এখানে থাকলে অফিস মিস করা উচিত হবে না।
আলম।
বল মামা।
একটা সাকসেসফুল অপারেশনের পর ওভার কনফিডেন্ট হবার একটা সম্ভাবনা থাকে। খুব সাবধান। এরা এখন পাগলা কুত্তার মত। দারুণ সতর্ক। পাগলা কুত্তারা খুব সতর্ক হয় জানিস তো?
আমরাও সতর্ক।
স্বপ্ন দেখে মনটা একটু ইয়ে হয়ে গেল। যদিও জানি আমার স্বপ্ন সব সময় উল্টো হয়। প্রমোশন পাওয়ার একটা স্বপ্ন দেখলাম একবার, হয়ে গেল ডিমোশন। অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি বানিয়ে বেইজ্জত করল।
শরীফ সাহেব। আবার হাসতে শুরু করলেন। অন্য রকম হাসি। অসুস্থ মানুষের হাসি।
বুঝলি আলম, এই যুদ্ধ দীর্ঘদিন চলবে। মে বি ফর ইয়ারস। চায়না কেমন চুপ মেরে আছে দেখছিস না? অন্য দেশগুলি চুপ করে আছে আমি মাইন্ড করছি না, কিন্তু চায়না পাকিস্তান সমর্থন করবে। কেন? হোয়াই? মানুষের জন্য মমতা নেই চায়নার এটা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। হোয়াই চায়না? হোয়াই?
অফিসে যাবে না। মামা?
না ইচ্ছা করছে না। শুয়ে থাকব। সিক রিপোর্ট করব। আসলেই সিক সিক লাগছে। দেখ তো কপালে জ্বর আছে কিনা।
জ্বর নেই।
না থাকলেও হবে। জ্বর হবে, সর্দি হবে, কাশি হবে। ডায়েরিয়া হবে।
শরীফ সাহেব শব্দ করে হাসতে লাগলেন। গা দুলিয়ে হাসি।
ঝিকাতলার একটি বাসায় সবাই একত্র হয়েছে। রহমানও আছে। সে এখন মোটামুটি সুস্থ। জ্বর নেমে গেছে। দাড়ি-গোঁফ কামানোয় তাকে বালক-বালক লাগছে। পরবর্তী অপারেশন নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। নতুন মানুষের ভেতর মিনহাজ উদ্দিনকে দেখা যাচ্ছে। তার কাছ থেকেই জানা গেল। আরো কিছু ছোট ছোট গ্রুপ শহরে ঢুকেছে। এরা পাওয়ার স্টেশন নষ্ট করতে চেষ্টা করবে। ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দেয়ার কাজটা বাইরে থেকে বোমা মেরে করা যাবে না। সাহায্য আসতে হবে ভেতর থেকে। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে।