আলম বলল, আপনি কী কিছু বলবেন?
সুরমা থেমে থেমে বললেন, তুমি বলেছিলে এ বাড়িতে সাত দিন থাকবে। আজ সাতদিন শেষ হয়েছে।
আমি আগামীকাল চলে যাব। আগামীকাল সন্ধ্যায়।
তোমাকে কী এক কাপ চা বানিয়ে দেব?
দিন। আপনার কাছে এ্যাসপিরিন আছে?
আছে। দিচ্ছি।
বলেও সুরমা গেলেন না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। আলম বলল, আপনি কী আরো কিছু বলবেন?
না।
মতিন সাহেবের নাক ফুলে উঠছে বারবার। হাত মুঠিবদ্ধ হচ্ছে। কারণ বিবিসি ঢাকার গেরিলা অপারেশনের খবর ফলাও করে বলেছে। এত তাড়াতাড়ি খবর পৌঁছল। কিভাবে? সাহেবদের কর্মদক্ষতার ওপর তাঁর আস্থা সব সময়ই ছিল। এখন সেটা বহুগুণে বেড়ে গেছে।
সুরমাকে ঢুকতে দেখেই তিনি বললেন, ব্রিটিশদের মত একটা জাত আর হবে না।
সুরমা তার কথা বুঝতে পারলেন না। হঠাৎ বৃটিশ প্রসঙ্গ এল কেন কে জানে।
সুরমা, আজদাহারা ছারখার করে দিয়েছে। অর্ধেক ঢাকা শহর বার্ন করে দিয়েছে। একেবারে ছাতু। হ্যাভক।
সুরমা কিছুই বললেন না। মতিন সাহেব ট্রানজিস্টার নিয়ে শোবার ঘরে চলে গেলেন। রাত্রিকে টেলিফোন করে জানতে হবে বিবিসি শুনছে। কিনা।
টেলিফোন ধরল অপালা। সে হাই তুলে বলল, বাবা আপাকে টেলিফোন দেয়া যাবে না। তার কি জানি হয়েছে, দরজা বন্ধ করে কাঁদছে।
মতিন সাহেব অবাক হয়ে বললেন, এ রকম খুশির দিনে কাঁদছে কেন?
রাত্রি ভোরবেলাতেই চলে এসেছে
রাত্রি ভোরবেলাতেই চলে এসেছে।
সুরমা রান্নাঘরে ছিলেন। সে চলে গেল রান্নাঘরে। সুরমা মেয়েকে দেখে বিস্মিত হলেন। এ কি চেহারা হয়েছে মেয়ের! মুখ শুকিয়ে কেমন অন্য রকম দেখাচ্ছে। চোখ লাল।
তোর কী হয়েছে?
কিছু হয়নি।
ঠিক করে বল কি হয়েছে?
রাতে ঘুম হয়নি মা। সারারাত জেগে ছিলাম।
সুরমা আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। রুটি বেলতে লাগলেন। বিন্তি রুটি সেঁকছে এবং নিজের মনেই হাসছে। রাত্রি হালকা গলায় বলল, আজ কি নাশতা মা?
সুরমা কঠিন গলায় বললেন–দেখতেই পাচ্ছিস কি! জিজ্ঞেস করছিস কেন?
রাত্রি মৃদু স্বরে বলল, আমার ওপর কেন তুমি রেগে যাচ্ছ মা? আমি কী কখনো তোমাকে রাগানোর জন্যে কিছু করেছি?
সুরমা উত্তর দিলেন না। রাত্রি আবার বলল, চুপ করে থাকবে না। বল তুমি, কখনো কী তোমাকে রাগানোর মত কোনো কারণ ঘটিয়েছি?
সুরমা দেখলেন রাত্রির চোখে জল টলমল করছে। যেন এক্ষুণি সে কেঁদে ফেলবে। তাঁর নিজেরো কান্না পেয়ে গেল। তিনি মনে মনে বললেন, কেউ যেন আমার এই মেয়েটির মনে কষ্ট না দেয়। বড় ভাল মেয়ে। বড় ভাল।
রাত্ৰি।
কি মা। আলমের ঘুম ভেঙেছে কিনা দেখে আয়।
বলেই সুরমা পাংশুবৰ্ণ হয়ে গেলেন। কেন রাত্রিকে এই কথা বললেন? তিনি ভালই জানেন আলম জেগে আছে। কিছুক্ষণ আগেই তিনি তাকে চা দিয়ে এসেছেন। রাত্রিকে এ কথা বলার উদ্দেশ্য কি এই যে তিনি তাকে খুশি করতে চেয়েছেন? কী ভয়ানক কথা! রাত্রি কি তার এই উদ্দেশ্য ধরতে পেরেছে? নিশ্চয়ই পেরেছে। সে বোকা মেয়ে নয়। নিজেকে সামলানোর জন্য তিনি থেমে থেমে বললেন–
আজ চলে যাবে। একটু যত্ন-টত্ন করা দরকার।
আজ চলে যাবেন নাকি?
হ্যাঁ। এক সপ্তাহ থাকার জন্যে এসেছিল। এক সপ্তাহ তো হয়ে গেল।
তিনি কি বলছেন। আজ চলে যাবেন?
হ্যাঁ বলেছেন।
রাত্ৰি হালকা পায়ে ঘর ছেড়ে গেল। তার গায়ে একটা ধবধবে সাদা সিল্কের শাড়ি। শাড়িতে বেগুনি ফুল। কি চমৎকার লাগছে রাত্রিকে। তাঁর মনে হল শুধুমাত্র মেয়েরাই সৌন্দর্য বুঝতে পারে। পুরুষরা পারে না। ওদের নজর থাকে শরীরের দিকে। সৌন্দর্য দেখবার সময় কোথায় ওদের।
আলম পা ঝুলিয়ে খাটে বসে আছে। তার কোলের উপর একটি বই। সে পা দুলাচ্ছে। রাত্রিকে ঢুকতে দেখে সে অল্প হাসল।
কখন এসেছেন?
এই তো কিছুক্ষণ আগে।
কী বই পড়ছেন এত মন দিয়ে?
আলম একটু উঁচু করে দেখাল ‘দত্তা’। রাত্ৰি হাসিমুখে বলল, অপালা এই বইটা মুখস্থ বলতে পারে। পাঁচ ছদিন পর পর এই বইটা সে একবার পড়ে ফেলে।
আলম বলল, আপনি কি অসুস্থ? কেমন যেন অন্য রকম লাগছে।
না, অসুস্থ না। আমি বেশ ভাল। দেখতে এসেছি আপনি কেমন আছেন। কাল সন্ধ্যাবেলা যা ভয় পেয়েছিলাম। কেন জানি মনে হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে আপনার। কি যে কষ্ট হচ্ছিল। আপনি কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবেন না।
আলমের অস্বস্তি লাগছে। এসব কি বলছে এই মেয়ে? কিন্তু এ তো সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলছে। আলম কথা ঘুরাবার জন্য বলল, কাল কি হয়েছে শুনতে চান?
না শুনতে চাই না। যুদ্ধ-টুদ্ধ আমার ভাল লাগে না।
কারোরই ভাল লাগে না।
রাত্রি খাটে আলমের মত পা ঝুলিয়ে বসল। মিষ্টি একটা গন্ধ বাতাসে ভাসছে। সৌরভ। কি মানুষের মনে বিষাদ জাগিয়ে তুলে? তুলে বোধ হয়। আলমের কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
রাত্রি বলল, আপনি নাকি আজ চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
কখন যাবেন?
বিকালে।
আপনি কি ঢাকাতেই থাকবেন, না চলে যাবেন অন্য কোথাও?
ঢাকাতেই থাকব।
আর আসবেন না আমাদের এখানে?
আসব না কেন, আসব।
আমার মনে হচ্ছে আপনি আর আসবেন না।
এ রকম মনে হচ্ছে কেন?
কেউ কথা রাখে না।
রাত্রি হঠাৎ উঠে চলে গেল। কারণ তার চোখ চলে ভরে আসছে। এই জল একান্তই নিজের, লুকিয়ে রাখার জিনিস। সে চলে গেল তার নিজের ঘরে।
অপালা সেখানে বসে আছে। তার হাতে একটা গল্পের বই। সে বই নামিয়ে বলল, কাদছ কেন আপা?
মাথা ধরেছে।
অপালা চোখ নামিয়ে নিল বইয়ে। সে নিজেও কাঁদছে। কারণ এই মুহূর্তে সে খুবই দুঃখের একটা ব্যাপার পড়ছে। নায়িকা সিঁড়ি থেকে পিছলে পড়েছে এবং চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। সে আর্তস্বরে চিৎকার করছে।–অরুণ! অরুণ! সে ডাক শুনেও নির্বিকার ভঙ্গিতে নেমে যাচ্ছে।