না, গাড়ি থামাও।
ভাল করে ভেবে বলেন।
গাড়ি থামাও। সবাই তৈরি থাক।
গাড়ি রাস্তার পাশে এসে থামল। আশফাকও তার পিকআপ থামিয়েছে।
তাদের সামনে দু’টি গাড়ি থেমে আছে। একটি ত্রিপল ঢাকা ট্রাক, অন্যটি ভোক্সওয়াগন। মুখ শুরু করে কয়েকজন লোক গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা ভয়ে অস্থির।
যারা গাড়ি থামাচ্ছে তারা মিলিটারি পুলিশ। একেকটা গাড়ি আসছে… হুঁইসেল দিয়ে হাত ইশারা করছে। গাড়ি থামামাত্র এগিয়ে যাচ্ছে–কাগজপত্র নিয়ে আসছে।
সংখ্যায় তারা চারজন। ভাল ব্যাপার হচ্ছে এই চারজনই দাঁড়িয়ে আছে কাছাকাছি। ছড়িয়েছিটিয়ে নেই। এদের একজনের সঙ্গে রিভলবার ছাড়া অন্য কিছু নেই। বাকি তিনজনের সঙ্গে আছে চাইনিজ রাইফেল।
আলম বলল, সাদেক তুই একা আমার সঙ্গে নামবি। অন্য কেউ না।
গৌরাঙ্গ।
বলুন।
সিগারেট এখন ফেলে দাও।
গৌরাঙ্গ সিগারেট ফেলে দিল। আলম জানালা দিয়ে মুখ বের করে হাত ইশারা করে ওদের ডাকল। মিলিটারি পুলিশের দলটি ক্রুদ্ধ ও অবাক হয়ে দৃশ্যটি দেখল। হাত ইশারা করে ওদের ডাকার স্পর্ধা এখনো কারোর আছে তা তাদের কল্পনাতেও নেই। একজন এগিয়ে আসছে, অন্য তিনজন দাঁড়িয়ে আছে।
আলম নামল খুব সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। তার পেছনে নামল সাদেক। সাদেকের মুখ ভর্তি হাসি।
এরা বুঝতে পারল না। এই ছেলে দু’টি ভয়াবহ অস্ত্র নিয়ে নেমেছে। এদের স্নায়ু ইস্পাতের মত।
প্রচণ্ড শব্দ হল গুলির। একটি গুলি নয়। এক ঝাক গুলি। ফাঁকা জায়গায় এত শব্দ হবার কথা নয়। কিন্তু হল। চারজনেই গড়িয়ে পড়ছে। এখনো রক্ত বেরুতে শুরু করেনি। ওদের মুখে আতংক ও বিস্ময়।
নাজমুল নেমে পড়েছে তার হাতে এসএলআর। আলম বলল, গাড়িতে উঠ নাজমুল। নেমেছ কেন?
দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলি একটা ঘোরের মধ্যে আছে কী হয়ে গেল তারা এখনো বুঝতে পারছে না। সাদেক বলল, আপনারা দাঁড়িয়ে থাকবেন না। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যান। লোকগুলির একজন শব্দ করে কাঁদছে। কী জন্যে কাঁদছে কে জানে। এখানে তার কাঁদবার কী হল?
এখানকার ঘটনা প্রচার হতে সময় লাগবে। তারা ফার্মগেটে পৌঁছে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। অবশ্যি গুলির শব্দ ওরা হয়ত পেয়েছে। এতে তেমন কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। এই শহরে গেরিলারা এসেছে এটা ওদের কল্পনাতেও নেই।
গাড়ি চলা শুরু করতেই সাদেক বলল, আমার বাথরুম পেয়ে গেছে। কেউ কোনো উত্তর দিল না। সাদেক আবার বলল, ডায়াবেটিস হয়ে গেল নাকি? এই কথারও কোনো জবাব পাওয়া গেল না।
গৌরাঙ্গ আবার একটি সিগারেট ধরিয়েছে। তার ফর্সা আঙুল অল্প অল্প কাঁপছে। আলম বলল, ভয় লাগছে গৌরাঙ্গ?
গৌরাঙ্গ সত্যি কথা বলল।
হ্যাঁ, লাগছে। বেশ ভয় লাগছে।
আলম তাকাল পেছনে। সাদেক চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। স্টেইনগানটি তার কোলে। কেমন খেলনার মত লাগছে। নূরু বসে আছে শক্ত মুখে। আলমের দিকে চোখ পড়তেই সে বলল, কিছু বলবেন আলম ভাই?
না কিছু বলব না।
সিগারেট ধরাবেন একটা?
না।
ঠিক এই মুহূর্তে কিছুই বলার নেই। কিছুই করার নেই। এটা হচ্ছে প্রতীক্ষার সময়। আলম লক্ষ্য করল বারবার তার মুখে থুথু জমা হচ্ছে। কেন এরকম হচ্ছে? তার কী ভয় লাগছে? তার সঙ্গে আছে চমৎকার একটি দল। এরা প্রথম শ্রেণীর কমান্ডে ট্রেনিং পাওয়া দল। এদের সঙ্গে নিয়ে যে কোনো পরিস্থিত সামাল দেয়া যায়। কোনো রকম ভয় তার থাকা উচিত নয়। কিন্তু আছে। ভালই আছে। নয়ত বারবার মুখে থুথু জমত না। সেই আদিম ভয় যা যুক্তি মানে না। মনের কোন এক গহীন অন্ধকার থেকে বিড়ালের মত নিঃশব্দে বের হয়ে আসে এবং দেখতে দেখতে ফুলে-ফোঁপে বিশাল হয়ে ওঠে। গাড়ির বেগ কমে আসছে। গৌরাঙ্গের চোেখ-মুখ শক্ত। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আলম ডাকল, সাদেক সাদেক। সাদেক ভারী গলায় বলল, আমি আছি। গৌরাঙ্গ বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। আলমের কেমন বমি-বমি ভাব হচ্ছে। তার জানতে ইচ্ছা করছে অন্যদেরও তার মত হচ্ছে কি-না। কিন্তু জানার সময় নেই। গাড়ি থেমে আছে। মিলিটারিদের তাঁবু দশ-পনেরো গজ দূরে।
দরজা খুলে তিনজনই লাফিয়ে নামল। নামজুল তখনো নামেনি।
পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কুড়িজনের একটি ইউনিট ছিল ফার্মগেটে। তাদের দলপতি সুবেদার মেজর মা বুদ খা। এই দলটিকে এখানে রাখার উদ্দেশ্য মান্বুদ খাঁর কাছে পরিষ্কার নয়। এদের ওপর তেমন কোন ডিউটি নেই। মাঝে মাঝে রোড ব্লক করে যে চেকিং হয় তা করে এমপি-রা। ওদের সঙ্গে ইদানীং যোগ দিয়েছে মিলিশিয়া।
তাঁবুর ভেতরটা বেশ গরম কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশির ভাগ সৈন্যই ঘুমুচ্ছিল। বা ঘুমের ভঙ্গিতে শুয়ে ছিল। যদিও এটা ঘুমুবার সময় নয়। কিছুক্ষণের ভেতরই বৈকালিন চা আসবে। চা আসতে আজ দেরি হচ্ছে। কেন দেরি হচ্ছে কে জানে।
মাবুদ খাঁ তাবুর বাইরে চেয়ারে বসে ছিল। শুধু শুধু বসে থাকা যায় না। কিন্তু তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার কোনো কাজ নেই। তাবুর ভেতর হৈচৈ হচ্ছে। তাস খেলা হচ্ছে সম্ভবত। এই খেলাটি তার অপছন্দ। সে মুখ বিকৃত করল এবং ঠিক তখনই সে লক্ষ্য করল তিনটি ছেলে দৌড়ে আসছে। দীর্ঘদিনের সামরিক ট্রেনিং তার পেছনে। তার বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হল না যে ছেলে তিনটি কেন ছুটে আসছে। সে মুগ্ধ হল এদের অর্বাচিন সাহসে। কিছু একটা বলল চিৎকার করে। সেটা শোনা গেল না। কারণ আকাশ কাঁপিয়ে একটা বিস্ফোরণ হয়েছে।