বিদ্যুতের গতিতে ছুটে গেলেন ময়না মিয়া। গ্রেনেড কেড়ে নিয়ে ছুড়ে মারবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হল। ময়না মিয়া নূরুকে নিয়ে মাটিতে শোবারও সময় পেলেন না। সৌভাগ্যক্রমে কারো কিছু হল না। ময়না মিয়া ঠাণ্ডা গলায় বললেন, নুরু ভাই, আরেকটা গ্রেনেড ছুড়েন। এখন আমি আছি আপনার কাছে। নূরু বলল, আমি পারব না। ময়না মিয়া প্রচণ্ড একটা চড় কষালেন। তারপর বললেন, যা বলছি করেন।
নূরু গ্রেনেড ছুড়ল। সার্জেন্ট মেজর ময়না মিয়া বললেন, নূরু ভাই হবেন গ্রেনেড মারায় এক নম্বর।
ময়না মিয়ার কথা সত্যি হয়েছে। ময়না মিয়া তা দেখে যেতে পারেননি। মান্দার অপারেশনে মারা গেছেন।
আলম ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। ময়না মিয়া কথা মনে হলেই মন দ্রবীভূত হয়ে যায়, বুক হুঁ-হু করে। দেশ স্বাধীন হবার আগে কী দেশের বীরপুত্রদের সবাই শেষ হয়ে যাবে? ·
আলম।
বল।
গাড়ি কোথাও রাখতে হবে, আমার পেচ্ছাব করতে হবে। কিডনি প্রেসার দিচ্ছে। একটা নর্দমার কাছে গাড়িটা থামা তো গৌরাঙ্গ।
গৌরাঙ্গ গাড়ি থামাল।
গাড়ি এগুচ্ছে খুব ধীরে। যেন কোন রকম তাড়া নেই। গৌরাঙ্গ পেছনের পিকআপটির দিকে লক্ষ্য রাখতে চেষ্টা করছে। ব্যাক মিররটা ভাল না। বাঁকা হয়ে আছে। পেছনে কে আসছে দেখার জন্যে ঘাড় বাঁকা করতে হয়। আলমের মনে হল গৌরাঙ্গ বেশ নাভাস।
গৌরাঙ্গ।
বলেন।
পেছনের দিকে লক্ষ্য রাখার তোমার কোনো দরকার নেই। তুমি চালিয়ে যাও।
জি আচ্ছা।
এত আস্তে না। আরেকটু স্পিডে চালাও। রিকশা তোমাকে ওভারটেক করছে।
গৌরাঙ্গ মুহূর্তে স্পিড বাড়িয়ে দিল। তার এতটা নার্ভাস হবার কারণ কী? আলম পরিবেশ হালকা করার জন্যে বলল, সেন্ট মেখেছি নাকি গৌরাঙ্গ? গন্ধ আসছে। কড়া গন্ধ।
গৌরাঙ্গ লজ্জিত স্বরে বলল, সেন্ট না। আফটার শেভ দিয়েছি।
দাড়ি-গোঁফ গজাচ্ছে না। আফটার শেভ কেন? সবাই হেসে উঠল। গৌরাঙ্গও হাসল। পরিবেশ হালকা করার একটা সচেতন প্রচেষ্টা। সবার ভাবভঙ্গি এ রকম যেন বেড়াতে যাচ্ছে। আলগা একটা ফুর্তির ভাব। কিন্তু বাতাসে উত্তেজনা। রক্তে কিছু একটা নাচছে। প্রচুর পরিমাণে এড্রোলিন চলে এসেছে পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে। সবার নিঃশ্বাস ভারী। চোখের মণি তীক্ষ্ণ। গৌরাঙ্গের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে সিগারেট ধরাল। স্টিয়ারিং হুঁইলে হাত রেখে সিগারেট ধরানোর কৌশলটা চমৎকার। আলম তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। তামাকের গন্ধ ভাল লাগছে না। গা গুলাচ্ছে। আলম একবার ভাবল, বলে–সিগারেট ফেলে দাও গৌরাঙ্গ। বলা হল না।
সাদেক পেছনের সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে। তার চোখ বন্ধ। সে বলল, আমি একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছি। সময় হলে জাগিয়ে দিও। রসিকতার একটা চেষ্টা। স্কুল ধরনের চেষ্টা। কিন্তু কাজ দিয়েছে। নূরু এবং গৌরাঙ্গ দাঁত বের করে হাসছে। সাদেক এই হাসিতে আরো উৎসাহিত হল। নাক ডাকার মত শব্দ করতে লাগল।
গাড়ি নিউ মার্কেটের সামনে দিয়ে সোজা ঢুকল মীরপুর রোডে। লালমাটিয়ার কাছাকাছি এসে ডানদিকে টার্ন নিয়ে চলে যাবে ফার্মগেট। সেখান থেকে হোটেল ইন্টারকনি। কাগজে-কলমে কত সহজ। বাস্তব অন্য জিনিস। বাস্তবে অদ্ভুত অদ্ভুত সব সমস্য হয়। মিশাখালিতে যে রকম হল। খবর পাওয়া গেল দশজন রাজাকার নিয়ে তিনজন মিলিটারির একটা দল সুলেমান মিয়ার ঘরে এসে বসে আছে, ডাব খাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে সাদেক দলবল নিয়ে রওনা হয়ে গেল। দুতিনটা গুলি ছুড়লেই রাজাকাররা তাদের পাকিস্তানি বন্ধুদের ফেলে পালিয়ে যাবে। অতীতে সব সময়ই এ রকম হয়েছে কিন্তু সেবার হয়নি। সুলেমান মিয়ার ঘরে যারা বসে ছিল তারা সবাই পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কমান্ডো ইউনিট। গ্রামে ঢুকেছে গানবোট নিয়ে। সাদেক মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছে। যাদের নিয়ে গিয়েছিল তাদের সবাইকে প্ৰায় রেখে আসতে হয়েছিল। ভয়াবহ অবস্থা।
নাজমুল বলল, আপনার ভয় লাগছে নাকি আশফাক সাহেব?
আশফাক ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমার এত ভয় নাই।
অ্যাকশন কখনো দেখেননি এই জন্যে ভয় নেই। একবার দেখলে বুকের রক্ত পানি হয়ে যায়। খুব খারাপ জিনিস।
আশফাক ব্ৰেকে পা দিল। সামনে একটা ঝামেলা হয়েছে। অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বোধ হয়। একটা ঠেলাগাড়ি উল্টে পড়ে আছে। তার পাশে হেডলাইট ভাঙা একটা সবুজ রঙের জিপ। প্রচুর লোকজন এদের ঘিরে আছে। আশফাক ভিড় কমাবার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। ভিড় কমছে। না। একজন ট্রাফিক পুলিশ মেয়েদের মত মিনমিনে গলায় কী সব বলছে, কেউ তার কথা শুনছে। না। নাজমুল বিরক্ত স্বরে বলল, ঝামেলা হয়ে গেল দেখি।
আশফাক নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি। সে জানালা দিয়ে মাথা বের করে ব্যাপারটা দেখবার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে সে এই ঝামেলাটায় বেশ মজা পাচ্ছে। কত অদ্ভুত মানুষ থাকে।
ভিড় চট করে কেটে যেতে শুরু করেছে। কারণ হচ্ছে ইপিআর এক নম্বর গেট থেকে একটি সাদা রঙের জিপ বাঁশি বাজাতে বাজাতে আসছে।
গৈৗরাঙ্গ একামিলেটরে পা দিল। নূরু বলল, যাত্রা শুভ না আলম ভাই। যাত্রা খারাপ।
এ ধরনের কথাবার্তা খুবই আপত্তিজনক। মনের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। এই মুহুর্তে আর কোনো বাড়তি চাপের প্রয়োজন নেই। আলম ঠাণ্ডা গলায় বলল, শুভ কাজের জন্যে যে যাত্রা তা সব সময়ই শুভ। গৌরাঙ্গ স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে। হুঁ-হু করে হাওয়া আসছে জানালা দিয়ে। লালমাটিয়ার কাছাকাছি আসতেই আবার ব্রেকে পা দিতে হল। গৌরাঙ্গ শুকনো গলায় বলল, আলম ভাই কী করব বলেন? ছুটে বেড়িয়ে যাব?