জানি, ছয়টায়।
এক ঘণ্টা পিছিয়ে দিল, ব্যাপারটা কী?
ঝামেলা নাই। গণ্ডগোল নাই। কার্ফুও নাই।
তা তো ঠিকই। এখন হয়েছে ছটা, তারপর হবে সাতটা, আটটা; কী বল?
তিনি কোনো উত্তর পেলেন না। ছেলেটা ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে আছে। আজকাল কেউ বাড়তি কথা বলতে চায না। চেনা মানুষদের কাছেও না।
রোদ উঠেছে কড়া এবং ঝাঁঝাল। কিন্তু এই কড়া রোদেও তার কেমন শীত শীত কবতে লাগল। তিনি ইদ্রিস মিয়ার দোকানের সামনে দ্বিতীয়বার এসে দাঁড়ালেন। মনে করতে চেষ্টা করলেন ঘরে যথেষ্ট সিগারেট আছে কিনা। পাঁচটার পর কোথাও কিছু পাওয়া যাবে না। গত সোমবারে সিগারেটের অভাবে খুব কষ্ট করেছেন। রাত নটার সময় বিন্তি এসে বলল, সিগারেটের প্যাকেট খুঁইজা পাই না। কি সর্বনাশ! বলে কী! তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। অমানিশি কাটবে কিভাবে? এটা ফ্ল্যাট বাড়ি না। ফ্ল্যাট বাড়ি হলে অন্যদের কাছে খোঁজ করা যেত। তবু তিনি রাত দশটার সময় পাচিলের কাছে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির উকিল সাহেবকে চিকন সুরে ডাকতে লাগলেন–ফরিদউদ্দিন সাহেব, সিগারেট আছে? সুরমা এসে তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন। রেগে আগুন হয়ে বললেন, মাথা কী খারাপ হয়ে গেছে? একটা রাত সিগারেট না ফুঁকলে কী হয়?
মতিন সাহেব মানিব্যাগ খুললেন। ইদ্রিস মিয়া তার দোকানে আগরবাতি জ্বলিয়েছে। সব দোকানদারের মধ্যে এই একটি নতুন অভ্যাস দেখা যাচ্ছে। আগরবাতি জ্বালানো। আগে কেউ কেউ সন্ধ্যাবেলা জ্বালাত। এখন প্রায় সারাদিনই জ্বলে। আগরবাতির গন্ধ মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। মতিনউদ্দিন সাহেব অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন।
ইন্দ্রিস, দুই প্যাকেট ক্যাপস্টান দাও।
ইদ্রিস সিগারেট বের করল। দাম এক টাকা করে বেশি নিল। সিগারেটের দাম চড়ছে। ছেলে-ছোকরারা এখন সারাদিন ঘরে বসে থাকে এবং সিগারেট ফুকে। এছাড়া আর কী করবে?
দু’টা ম্যাচও দাও।
ইদ্রিস মিয়া ম্যাচ দিতে দিতে বলল, আফনে কাউরে খুঁজতেছেন?
তিনি চমকে উঠলেন। বলে কী এই ব্যাটা? টের পেল কিভাবে?
কারে খুঁজেন?
আরে না, কাকে খুঁজবে? চুল কাটাতে গিয়েছিলাম। চুল একটু বড় হলেই আমার অসহ্য লাগে।
তিনি বাড়ির দিকে রওনা হলেন। গোরস্থান ঘেষে রাস্তা গিয়েছে। সেই জন্যেই কী গা ছমছম করে? না অন্য কোনো কারণ আছে? একটা কটু গন্ধ আসছে। নিউ পল্টন লাইনের লোকজনদের ধারণা, বর্ষাকালে এই গন্ধ পাওয়া যায়। লাশ পচে গন্ধ ছড়ায়। এখন বর্ষাকাল। গোরস্থানের পাশে বাড়ি ভাড়া নেয়াটা ভুল হয়েছে। বিরাট ভুল।
বিন্তি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। মতিন সাহেবকে দেখে সে দাঁত বের করে হাসল। এই মেয়েটার হাসি-রোগ আছে। যখন-তখন যার-তার দিকে তাকিয়ে হাসবে। অভদ্রের চূড়ান্ত। কড়া ধমক দিতে হয়। তিনি ধমক দিতে গিয়েও দিলেন না। সোজা ঘরে ঢুকে খেতে বসলেন।
সুরমা ও বসেছেন। কিন্তু তিনি কিছু খাচ্ছেন না। ঝগড়া-টগড়ার পর তিনি খাওয়া-দাওয়া আলাদা করেন। মাঝে মাঝে করনেও না। মতিন সাহেব ভাত মাখতে মাখতে বললেন, আজ কাৰ্য্য ছয়টা থেকে। সুরমা তীক্ষা কণ্ঠে বললেন, তাতে কী?
না কিছু না। এমনি বললাম। কথার কথা।
আজ অফিসে গেলে না কেন?
শরীরটা ভাল না।
একটা সত্যি কথা বল তো, কেউ কী আসবে?
তিনি বিষম খেলেন। পানি-টানি খেয়ে ঠাণ্ডা হতে তাঁর সময় লাগল। সুরমা তাকিয়ে আছেন। তাঁর মুখ কঠিন। মতিন সাহেব ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। এক সময়ে সুরমার এই মুখ খুব কোমল ছিল। কথায় কথায় রাগ করে কেঁদে ভাসাত। একবার তাকে এক সপ্তাহের জন্যে রাজশাহী যেতে হবে। সুরমা গান্তীর হয়ে আছে। কথাটথা বলছে না। রওনা হবার আগে আগে এমন কান্না! মতিন সাহেব বড় লজ্জার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। বাড়ি ভর্তি লোকজন। এদের মধ্যে মেজো ভাবীও আছেন। মেজো ভাবীর মুখ খুব আলগা। তিনি নিচু গলায় বাজে ধরনের একটা রসিকতা করলেন। কী অস্বস্তি। পাঁচশ বছর খুব কী দীর্ঘ সময়? এই সময়ের মধ্যে একটি কোমল মুখ চিরদিনের জন্যে কঠিন হয়ে যায়?
কি, কথা বলছি না কেন?
কী বলবি?
কারোর কী আসার কথা?
আরে না, কে আসবে?
সত্যি করে বল।
মতিন সাহেব থেমে থেমে বললেন, ইয়ে আমার এক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়।
কে সে?
তুমি চিনবে না।
তোমার আত্মীয় আর আমি চিনব না—কী বলছ এ সব?
দেখা-সাক্ষাৎ নেই তো। আমি নিজেই ভাল করে চিনি না।
তুমি নিজেও চেন না?
সুরমার কপালে ভাঁজ পড়ল। মতিন সাহেব অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। তিনি মৃদু স্বরে বললেন, দুই-এক দিন থাকবে। তারপর চলে যাবে। নাও আসতে পারে। ঠিক নাই কিছু। না আসারই সম্ভাবনা।
সে করে কী?
জানি না।
জানি না মানে?
বললাম তো আমি নিজেও চিনি না ভাল করে। যোগাযোগ নেই।
মতিন সাহেব উঠে পড়লেন। সাধারণত ছুটির দিনগুলিতে তিনি খাওয়া-দাওয়ার পর গল্পের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েন। আজ ছুটির দিন নয়। কিন্তু তিনি অফিসে যাননি। কাজেই দিনটিকে ছুটির দিন হিসাবে ধরা যেতে পারে। তার উচিত একটা বই নিয়ে বিছানায় চলে যাওয়া। তিনি তা করলেন না। বই হাতে বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসলেন। চোখ রাস্তার দিকে।
দিনের আলো আসছে। আকাশে মেঘা জমতে শুরু করেছে। পর পর কয়েকদিন খটখাটে রোদ গিয়েছে। এখন আবার কয়েকদিনের ক্রমাগত বৃষ্টি হবার কথা। বাড়ির ভেতরে সুরমা বসেছে তার সেলাই মেশিন নিয়ে। বিশ্ৰী ঘটাং ঘটাং শব্দ হচ্ছে। মতিন সাহেবের ঘুম পেয়ে গেল। হাতে ধরে থাকা বইটির লেখাগুলি ঝাপসা হয়ে উঠেছে। ঝাপসা এবং অস্পষ্ট। রোদ নেই। একেবারেই। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বৃষ্টি হবে, জোর বৃষ্টি হবে। তিনি বই বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকালেন। বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান। সুরমা ক্রমাগতই খটখট করে যাচ্ছে। কিসের তার এত সেলাই? আচ্ছা ছেলেবেলায় সুরমা কেমন ছিল? প্রতিটি মানুষ একেক বয়সে একেক রকম। যৌবনে সুরমা কত মায়াবতী ছিল। বর্ষার রাতগুলি তাঁরা গল্প করে পার করে দিতেন। একবার খুব বর্ষা হল। খোলা জানালায় বৃষ্টির ছাঁট এসে বিছানা ভিজিয়ে একাকার করেছে। তবু তাঁরা জানালা বন্ধ করলেন না। ভেজা বিছানায় শুয়ে রইলেন। হাওয়া এসে বারবার মশারিকে নৌকার পালের মত ফুলিয়ে দিতে লাগল। কত গভীর আনন্দেই না কেটেছে তাদের যৌবন। মতিন সাহেব কালো আকাশেব দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন।