কী বলছিস এসব কিছু বুঝতে পারছি না।
অপালা বিরক্ত স্বরে বলল, বাবা, আমি এখন রেখে দিচ্ছি। সে সত্যি সত্যি টেলিফোন রেখে দিল।
রাত্রি পা বুলিয়ে খাটে বসে আছে। তার সামনে বসে আছেন মিসেস রাবেয়া করিম। রাত্রির ধারণা ছিল একজন বুড়োমত মহিলা আসবেন। তার পরনে থাকবে সাদা শাড়ি। তিনি আড়চোখে রাত্রিকে কয়েকবার দেখে ভাসা ভাসা ধরনের কিছু প্রশ্ন করবেন–বাড়ি কোথায়? ক ভাইবোন? কী পড়? কিন্তু তার সামনে যিনি বসে আছেন তিনি সম্পূর্ণ অন্য রকম মহিলা। রেডক্রস লাগানো কালো একটি মরিস মাইনর গাড়ি নিজে চালিয়ে নিয়ে এসেছেন। মহিলাদের গাড়ি চালানো এমন কিছু অদ্ভুত ব্যাপার নয়। অনেকেই চালাচ্ছে। নাসিমাও চালায় কিন্তু এই সময়ে একজন একা একা গাড়ি করে যাওয়া-আসা করে না।
ভদ্রমহিলা বেশ লম্বা। মাথার চুল কাঁচাপাকা। মুখটি কঠিন হলেও চোখ দু’টি হাসি হাসি। অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী একজন মহিলা। রাত্রিকে দেখে প্রথম যে কথাটি বললেন তা হচ্ছে–তোমার ইন্টারভ্যু নিতে এলাম মা। রাত্রি হকচাকিয়ে গেল।
প্রথমে নিজের পরিচয় দিয়ে নেই। আমি একজন ডাক্তার। মেডিকেল কলেজে গাইনির এসোসিয়েট প্রফেসর। আমার নাম রাবেয়া। তোমার ভাল নামটি কী?
ফারজানা।
তুমি বস এবং বল এত সুন্দর তুমি কি ভাবে হলো? এটা আমার প্রথম প্রশ্ন। খুব কঠিন প্রশ্ন। ভদ্রমহিলা হাসতে লাগলেন। রাত্রি কী বলবে ভেবে পেল না। হঠাৎ করে কেউ সুন্দর হয় না। এর পেছনে জেনেটিক কারণ থাকে। মনের সৌন্দর্য একজন নিজে নিজে ডেভেলপ করাতে পারে। কিন্তু দেহের সৌন্দৰ্য উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে হয়। বল, তোমার মা এবং বাবা এদের দুজনের মধ্যে কে সুন্দর?
মা।
শোন রাত্রি, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তা কিছুই মিন করে না। তোমার পছন্দ-অপছন্দ আছে। এবং আমার মনে হচ্ছে তুমি খুব খুতখুতে ধরনের মেয়ে। আমি কী ঠিক বলেছি?
ঠিকই বলেছেন।
ভদ্রমহিলা চা খেলেন। অপালার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করলেন এবং এক পর্যায়ে একটি হাসির গল্প বললেন। হাসির গল্পটি একটি ব্যাঙ নিয়ে। পরপর কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় ব্যাঙটির সর্দি হয়ে গেছে। ব্যাঙ সমাজে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেছে। বেশ লম্বা গল্প। অপালা মুগ্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর পর হাসিতে ভেঙে পড়তে লাগল।
ভদ্রমহিলা এসেই বলেছিলেন আধঘণ্টা থাকবেন। কিন্তু তিনি পুরোপুরি তিন ঘণ্টা থাকলেন। দুপুরের খাবার খেলেন। খাবার শেষ করে রাত্রিকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে গেলেন। অস্বাভাবিক নরম গলায় বললেন, মা, তোমাকে কী আমি আমার ছেলের সম্পর্কে দু’একটি কথা বলতে পারি?
রাত্রি লজ্জিত স্বরে বলল, বলুন।
তার সবচে দুর্বল দিকটির কথা আগে বলি। ওর থিংকিং প্রসেসটা একটু স্লো বলে আমার মনে হয়। যখন কেউ কোনো হাসির কথা বলে তখন সে প্রায়ই বুঝতে পারে না। বোকা মানুষদের মত বলে –ঠিক বুঝতে পারলাম না।
রাত্রি অবাক হয়ে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি এই কথাটি বলবেন তা বোধ হয়। সে ভাবেনি।
এখন বলি ওর সবচে সবল দিকটির কথা। পুরনো দিনের গল্প-উপন্যাসে এক ধরনের নায়ক আছে যারা জীবনে কোন পরীক্ষাতে সেকেন্ড হয় না; ও সে রকম একটি ছেলে। মা, আমি খুব খুশি হব তুমি যদি খানিকক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বল। আমার ধারণা, কিছুক্ষণ কথা বললেই তোমার ওকে পছন্দ হবে। অবশ্যি ও কথা বলবে কিনা জানি না। যা লাজুক ছেলে!
ছেলেটিকে না দেখেই রাত্রির কেমন যেন পছন্দ হল। কথা বলতে ইচ্ছা হল। তার একটু লজ্জা লজ্জাও লাগল। ভদ্রমহিলা বললেন, মা, তুমি কী ওর সঙ্গে কথা বলবে?
হ্যাঁ বলবে।
থ্যাংক য়্যু। যাই কেমন? যাই বলার পরও তিনি আরো কিছুক্ষণ থাকলেন। নাসিমার সঙ্গে গল্প করলেন। অপালাকে আরো একটি হাসির গল্প বললেন। সেই গল্পটি তেমন জমল না। অপালা গম্ভীর হয়ে রইল।
ওরা মডার্ন নিওন সাইন থেকে বেরুল দুপুর দুটায়। রহমানকে রেখে যেতে হল। কারণ তার উঠে দাঁড়াবার সামর্থ্য নেই। আলম চেয়েছিল রহমানকে তার জায়গায় রেখে আসতে। দলের সবাই আপত্তি করল। নাড়াচাড়া করার কোনো দরকার নেই। এখানে বিশ্রাম করুক। আশফাক বলল, জহুর মিয়া আছে সে দেখাশোনা করবে। দরকার হলে চেনা একজন ডাক্তার আছে তাকে নিয়ে আসবে। কোনই অসুবিধা নেই।
আলম গম্ভীর হয়ে রইল। রহমানকে বাদ দিয়ে আজকের অপারেশন শুরু করতে তার মন চাইছে না। এবং কেন যেন জায়গাটাকে তার নিরাপদ মনে হচ্ছে না। সারাক্ষণই মনে হচ্ছে কিছুএকটা হবে।
এরকম মনে হবার তেমন কোন কারণ নেই। এই শহরে মিলিটারিরা নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করছে। এরা এখানে শংকিত নয়। আলাদাভাবে কোনো বাড়িঘরের দিকে নজর দেবে না। নজর দেবার কথাও নয়। সাদেক বলল, আলম, তুই এত গান্তীর কেন? ভয় পাচ্ছিস নাকি? আলম বলল, বেরিয়ে পড়া যাক।
তারা উঠে দাঁড়াল। আশফাককে নিয়ে ছজনের একটি দল। আলম বলল, রহমান চললাম। রহমান উত্তর দিল না। তাকিয়ে রইল। তার জ্বর নিশ্চয়ই বেড়েছে। চোখ ঘোলাটে। জুরের জন্য মুখ লাল হয়ে আছে।
তারা রাস্তায় বেরুতেই একটি মিলিশিয়াদের ট্রাক চলে গেল। মিলিশিয়ারা ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছে। মনে হয়, অল্প কিছুদিন হল এ দেশে এসেছে। নতুন পরিবেশে নতুন ধরনের জীবনযাত্রায় এখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি।
সাদেক বলল, রওনা হবার আগে পান খেলে কেমন হয়? কেউ পান খাবে?