পানওয়ালা ইদ্রিস বলল, অফিসে যান না?
না। শরীরটা ভাল না। দেখি একটা পান দাও।
পান খাওয়ার তার দরকার ছিল না। এ সময়ে সবাই অদরকারি কাজগুলি করে, অপ্রয়োজনীয় কথা বলে। ভয় কাটানোর জন্যেই করে। ভয় তবু কাটে না। যত দিন যায় ততই তা বাড়তে থাকে।
দু’টা ছেলেকে ধরে নিয়ে গেল। দেখলে ইদ্রিস মিয়া?
জি দেখলাম। নেন। পান নেন। মতিন সাহেব পান মুখে দিয়ে নিচু গলায় বললেন, এই অবস্থা বেশি দিন থাকবে না। আজাদহা নেমে গেছে।
বলেই তিনি হকচাকিয়ে গেলেন। একজন পানওয়ালার সঙ্গে এসব কি বলছেন? ইদ্রিস মিয়া হয়ত তার কথা পরিষ্কার শোনেনি। কিংবা শুনলেও অর্থ বুঝতে পারেনি। সে একটি আগরবাতি জ্বালাল। আগেরটি শেষ হয়ে গেছে।
সুরমা একবার জিজ্ঞেসও করলেন না— অফিসে যাওনি কেন? তিনি নিজের মনে কাজ করে যেতে লাগলেন। সাবান পানি দিয়ে ঘরের মেঝে নিজের হাতে মুছলেন। কার্পেট শুকাতে দিলেন। বাথরুমে ঢুকলেন প্রচুর কাপড় নিয়ে। আজ অনেকদিন পর কড়া রোদ উঠেছে। রোদটা ব্যবহার করা উচিত।
মতিন সাহেব কি করবেন ভেবে পেলেন না। কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে রইলেন। তারপরই তার মনে হল অফিসে না গিয়ে তিনি বারান্দায় বসে আছেন এটা লোকজনের চোখে পড়বে। তিনি ভেতরের ঘরে গেলেন। ঝকঝকে মেঝে মাড়িয়ে যেতে খারাপ লাগে। সুরমা কিছু বলছেন না। কিন্তু তাকিয়ে আছেন কড়া চোখে। মতিন সাহেব বাগানে গেলেন। বাগান মানে বারান্দার কাছ ঘেষে এক চিলতে উঠোন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এখানে শাকসব্জি ফলাবার চেষ্টা করছেন। ফলাতে পারেননি। মরা মরা ধরনের কিছু গাছপালা হয়ে কিছুদিন পর আপনা-আপনি শুকিয়ে যায়। সার-টার সব দিয়েও একই অবস্থা। নিজেই একবার মাটি নিয়ে জয়দেবপুর গিয়েছিলেন সয়েল টেস্টিং-এর জন্যে। তারা এক সপ্তাহ পর যেতে বলল। তিনি গেলেন এক সপ্তাহ পর। তিন ঘণ্টা বসে থাকার পর কামিজ পরা অত্যন্ত স্মার্ট একটি মেয়ে এসে বলল, আপনার স্যাম্পল তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি কী কষ্ট করে আরেকবার খানিকটা স্যাম্পল দিয়ে যেতে পারবেন? দু’একদিনের মধ্যে নিয়ে আসুন। তিনি নিয়ে যাননি।
কয়েকদিন ক্রমাগত বৃষ্টির জন্যে বাগানে কাদা হয়েছে। জুতো সুদ্ধ পা অনেকখানি কাদায় ডেবে গেল। তিনি অবশ্যি তা লক্ষ্য করলেন না। কারণ তার চোখ গিয়েছে কাকরুল গাছের দিকে। কাকরুল গাছ যে বাগানে হয়েছে তা তার মনে ছিল না। আজ হঠাৎ দেখলেন একটা সতেজ গাছ। চড়া সবুজ রঙের পাকা চকচক করছে। তার চেয়েও বড় কথা–পাতার ফাকে বড় বড় কাঁকরুল ঝুলছে। কেউ লক্ষ্য করেনি। একটি আবার পেকে হলুদ বর্ণ হয়েছে। মতিন সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন–রাত্রি, রাত্রি। রাত্রি বাসায় নেই। ভোরবেলা তার চোখের সামনে গাড়ি এসে নিয়ে গিয়েছে তা তার মনে রইল না। উত্তেজিত স্বরে তিনি দ্বিতীয়বার ডাকলেন – রাত্রি, রাত্রি।
সুরমা ঘর মোছা বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ বিষন্ন। খানিকটা উদ্বেগ মিশে আছে সেখানে। তিনি বললেন, কি হয়েছে?
সুরমা, কাঁকরুল দেখে যাও। গাছ ভর্তি হয়ে আছে। কেউ এটা লক্ষ্যই করে নাই। কি কাণ্ড! সুরমা সত্যি সত্যি নেমে এলেন। তাঁর যা স্বভাব তাতে নেমে আসার কথা নয়। নোংরা কাদা থিাকথিক বাগানে পা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
সুরমা, দেখ দেখ, পুঁই গাছটার দিকে দেখ। কেন এসব এতদিন কেউ দেখল না?
মতিন সাহেব গভীর মমতায় গাছের পাতায় হাত বুলাতে লাগলেন।
শুধু পুঁই গাছ নয়। রান্নাঘরের পাশের খানিকটা জায়গায় ডাটা দিয়েছিলেন। লাল লাল পুরুষ্ট ডাটা সেখানে। নিম্বফলা মাটিতে হঠাৎ করে প্রাণ সঞ্চার হল নাকি? আনন্দে মতিন সাহেবের দম বন্ধ হয়ে যাবার মত হল। রাত্রিকে খবর দিতে হবে। ওরা এলে একসঙ্গে সবজি তোলা হবে। তাছাড়া বাগান পরিষ্কার করতে হবে। বড় বড় ঘাস জন্মেছে। এদের টেনে তুলতে হবে। মাটি কুপাতে হবে। ডাটা ক্ষেতে পানি জমেছে, নালা কেটে পানি সরাতে হবে। অনেক কাজ। অফিসে না গিয়ে ভাল হয়েছে। রাত্রিকে খবর দেয়া দরকার। মতিন সাহেব কাদামাখা জুতো নিয়েই শোবার ঘরে ঢুকে পড়লেন। রাত্রিকে টেলিফোন করলেন। সুরমা দেখলেন তার ধোয়া-মোছা মেঝের কি হাল হল। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না।
রাত্রিকে টেলিফোনে পাওয়া গেল না। নাসিমা বলল, ওর সঙ্গে এখন কথা বলা যাবে না। তুমি ঘণ্টাখানিক পরে রিং করবে।
মতিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, এখন সে কি করছে?
একজন ভদ্রমহিলা তাকে দেখতে এসেছেন। সে কথা বলছে তার সঙ্গে।
কেন দেখতে এসেছে রাত্রিকে?
কেন তুমি জান না? তোমাকে তো বলা হয়েছে।
নাসিমা ব্যাপারটা কি খুলে বল তো!
এখন বকবক করতে পারব না। রান্নাবান্না কবছি। উনি খাবেন। এখানে।
কে এখানে খাবেন?
দাদা, পরে তোমাকে সব গুছিয়ে বলব। এখন রেখে দেই। তুমি বরং অপালার সঙ্গে কথা বল। ওকে ডেকে দিচ্ছি।
মতিন সাহেব রিসিভার কানে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। অপালা আসছেই না। কোন একটা গল্পের বই পড়ছে নিশ্চয়ই। গল্পের বই থেকে তাকে উঠিয়ে আনা যাবে না। তিনি যখন টেলিফোন রেখে দেবেন বলে মন ঠিক করে ফেলেছেন তখন অপালার চিকন গলা শোনা গেল।
হ্যাঁলো বাবা।
হুঁ।
কি বলবে তাড়াতাড়ি বল।
মতিন সাহেব উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন, তোদের ওখানে কি হচ্ছে?
আপার বিয়ে হচ্ছে।
কি বললি?
আপার বিয়ে হচ্ছে। বিবাহ। শুভ বিবাহ।