তোমার গাড়ি পাঠালাম রাত্রিদের আনবার জন্যে।
ও আচ্ছা।
ইয়াদ সাহেব। আবার ঘুমুবার আয়োজন করলেন।
তুমি কিন্তু আজ অফিসে-টিফিসে যাবে না।
কেন?
আজ রাত্ৰিকে দেখতে আসবে। তোমার থাকা দরকার।
আমি থেকে কী করব?
কিছু করবে না। থাকবে। আর কী। এসব কাজে ব্যাকগ্রাউন্ডে একজন পুরুষ মানুষ থাকা দরকার।
দরকার হলে থাকব। এখন একটু ঘুমাই, কী বল?
আচ্ছা ঘুমাও।
ইয়াদ সাহেব চোখ বন্ধ করে পাশ ফিবলেন। ছুটে যাওয়া ঘুম ফিরে এল না। কিছুদিন থেকেই তাঁর দিন কাটছে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায়। মোহাম্মদপুরে তাঁদের মূল বাড়িটি বিহারীদের দখলে। দেশ স্বাধীন না হলে এ বাড়ি ফিরে পাওয়া যাবে না। অসম্ভব। দেশ চট করে স্বাধীন হয়ে যাবে। এ রকম কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। চট করে পৃথিবীর কোনো দেশই স্বাধীন হয়নি। ইংরেজ তাড়াতে কত দিন লেগেছে? এখানেও তাই হবে। বছবের পর বছর লাগবে। তারপর এক সময় বাঙালিরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে। এই একটা অদ্ভুত জাতি। নিমিষেব মধ্যে উৎসাহে পাগল হয়ে ওঠে, আবার সে উৎসাহ নিভেও যায়।
ইয়াদ সাহেব উঠে বসলেন। কাজের ছেলেটিকে বেড টি-র কথা বলে চুরুট ধরালেন। তাঁর বমি বমি ভাব হল। তিনি বিছানা থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে বারান্দায় গেলেন। বারান্দার সামনে ঘুপসিমত গলি। মোহাম্মদপুরের বিশাল বাড়ি ছেড়ে তাকে থাকতে হচ্ছে ভাড়া বাড়িতে যার সামনে ঘুপসি গলি। তিনি বেঁচে থাকতে থাকতে কী দেশ স্বাধীন হবে? ফিরে পাওয়া যাবে নিজের বাড়ি? ইয়াদ সাহেব খানিকটা লজ্জিত বোধ করলেন। তিনি দেশের স্বাধীনতা চাইছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে–এটা ঠিক হচ্ছে না।
চায়ের পেয়ালা নিয়ে তিনি বাসিমুখে নিজের স্টাডি রুমে ঢুকলেন। তাঁর অফিসের যাবতীয় কাগজপত্র এই ছোট্ট ঘরটিতে আছে। এখানে তিনি দীর্ঘ সময় কাটান। নিজের তৈরি বু, প্রিন্টগুলির দিকে তাকিযে থাকতে তার ভাল লাগে। কিন্তু আজ কিছুই ভাল লাগছে না। আলস্য অনুভব করছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য এখন কিছুই নেই। সব রকম কনসট্রাকশনের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। সরকারের কাছে মোটা অংকের টাকা পাওনা। সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। যাবেও না। সন্তাত; সব জলে যাবে। তাঁর মতে বাঙালিদের এই যুদ্ধে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কনসট্রাকশন ফার্মগুলি। এদেব কোমর ভেঙে গেছে। এই কোমর আর ঠিক হবে না। দেশ স্বাধীন হলেও না। তিনি একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। কলিং বেল বাজছে। মেযে দু’টি এসেছে নিশ্চয়ই। এদের তার ভাল লাগে না। কিন্তু তবু তিনি হাসি মুখে দরজা খুলে বের হলেন। এবং অমায়িক ভঙ্গিতে বললেন রাত্রি মা, কেমন আছ?
ভাল আছি ফুফা।
অপালা মা, মুখটা এমন কালো কেন?
অপালা জবাব দিল না। সে তার ফুফাকে পছন্দ কবে না। একেবাইে না। ইয়াদ সাহেব বললেন, কী গো মা, কথা বলছি না কেন?
কথা বলতে ভাল লাগছে না, তাই বলছি না।
ইয়াদ সাহেব চুপ করে গেলেন।
আলম দোকানটির সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত কবতে লাগল। এটিই কী সেই দোকান? নাম অবশ্যি সে রকমই মডার্ন নিওন সাইনস। এখানেই সবাব জড় হবার কথা। কিন্তু দোকানটি সদর রাস্তার উপরে। তাছাড়া ভেতরে যে লোকটি বসে আছে তার চেহারা কেমন বিহারি বিহারি। কার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে বলতে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। কোন বাঙালি ছেলে এই সময়ে এমনভাবে হাসবে না। এটা হাসির সময় না। আলম দোকানে ঢুকে পড়ল।
চেক হাওয়াই শার্ট পাবা ছেলেটির ঠোঁটের উপর সুচালো গোফ। গলায় সোনার চেইন বের হয়ে আছে। রোগা টিঙটিঙে কিন্তু কথা বলার ভঙ্গি কেমন উদ্ধত। ছেলেটি টেলিফোন নামিয়ে রাগী গলায় বলল, কাকে চান?
এটা কি মডার্ন নিওন সাইন?
হ্যাঁ।
আমি আশফাক সাহেবকে খুঁজছি।
আমিই আশফাক। আপনার কী দরকার?
আমার নাম আলম।
ছেলেটির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হল। কিন্তু কথা বলল নরম গলায়–আপনি ভেতরে ঢুকে যান। সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় চলে যান।
আর কেউ এসেছে?
রহমান ভাই এসেছে। যান, আপনি ভেতরে চলে যান।
ভেতরটা অন্ধকার। অসংখ্য নিওন টিউব চারদিকে ছড়ানো। একজন বুড়ো মত লোক এই অন্ধকারেই বসে কী সব নকশা করছে। সে একবার চোখ তুলে আলমকে দেখল। তার কোনো রকম ভাবান্তর হল না। চোখ নামিয়ে নিজের মত কাজ করতে লাগল।
দোতলায় দু’টি ঘর। একটিতে প্রকাণ্ড একটি তালা ঝুলছে। অন্যটি খোলা। রঙিন পর্দা ঝুলছে। রেলিং-এ মেয়েদের কিছু কাপড়। ঘরের ভেতর থেকে ক্যাসেটে গানেব শব্দ আসছে। হাওয়ামে উড়তা যায়ে মেরা লাল দুপাট্টা মলমল। আলম ধাঁধায় পড়ে গেল। সে মৃদু স্বরে ডাকল, রহমান রহমান।
রহমান বেরিয়ে এল। তার গায়ে একটা ভারী জ্যাকেট। মুখ শুকনো। এমনিতেই সে ছোটখাটো মানুষ। এখন তাকে আরো ছোট দেখাচ্ছে। রহমান হাসতে চেষ্টা করল।
আসুন আলম ভাই। তোমার এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে? শরীর খারাপ করে ফেলেছে। জ্বর, সর্দি, কাশি বুড়োদের অসুখ-বিসুখ। একশ দুই। অসুবিধা হবে না। চারটা এ্যাসপিরিন খেয়েছি। জ্বর নেমে যাবে। সকালে একশ তিন ছিল। ভেতরে আসুন আলম ভাই।
ভেতরে কে কে আছে?
কেউ এখনো এসে পৌঁছেনি। আমি ফাস্ট, আপনি সেকেন্ড। এসে পড়বে।
আলম ঘরে ঢুকল। ছোট্ট ঘর। আসবাবপত্রে ঠাসা। বেমানান একটা কাক কাৰ্য করা বিশাল খাট। খাটের সঙ্গে লাগোয়া একটা স্টিলের আলমারি। তার একটু দূবে ড্রেসার। জানালোব কাছে খাটের মতই বিশাল টেবিল। এত ছোট্ট একটা ঘবে এতগুলি আসবাবেব জায়গা হল কী ভাবে কে জানে।