পনেরই জুলাই থেকে মেট্রিক পরীক্ষা। ঐ দিন একটা শো-ডাউন হবে বলে মতিন সাহেবের ধারণা। মুক্তিবাহিনীর আজাদহারা নিশ্চয়ই পরীক্ষা বানচাল করবার কাজে নামবে। ঐ দিন একটা উলট পালট হয়ে যাবে। এটা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। মতিন সাহেব তার রক্তের ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করলেন।
সুরমা রাতের খাবারের আয়োজন করছিলেন। তাঁর মুখ বিষন্ন। কোনো কারণে তিনি খুবই বিচলিত। কারণটি কি নিজেও স্পষ্ট জানেন না। মাঝে মাঝে তার এ রকম হয়। বাত্রি এসে মার পাশে দাঁড়াল। সুরমা বললেন, কিছু বলবি?
হ্যাঁ মা, উনাকে ভেতরের ঘরে থাকতে দেয়া উচিত।
আলমের কথা বলছিস?
হ্যাঁ। বসার ঘরে থাকলেই সবার চোখে পড়বে। ফুফু, টেলিফোনে জিজ্ঞেস করছিলেন। তাঁদের ড্রাইভার দেখে গেছে।
এখন আবার ভেতরের ঘরে নিয়ে গেলে সেটা কী আরা বেশি করে চোখে পড়বে না?
রাত্রি কিছু বলতে পারল না। বেশির ভাগ সময়ই সুরমা চমৎকার মুক্তি দিয়ে কথা বলেন।
রাত্রি।
বল মা।
ভেতরে নেয়ার আরেকটি সমস্যা কী জানিস? ছেলেটি অস্বস্তি বোধ করবে। একবার ভেতরে নেয়া হচ্ছে একবার বাইরে। আবার ভেতরে। আমি কী ঠিক বলছি। রাত্রি?
ঠিকই বলছি।
সুরমা অস্পষ্টভাবে হাসলেন। মৃদু স্বরে বললেন, তোর যখন ইচ্ছা তাকে ভেতরেই নিয়ে আয়। বিন্তিকে বল ঘর পরিষ্কার করতে। অপালা কী করছে? তাকে তো কোনো কাজেই পাওয়া যায় না। মুখের সামনে গল্পের বই ধরে বসে আছে। ওকেও লাগিয়ে দে।
রাত্রি কাউকে লাগাল না, নিজেই পরিষ্কার করতে লাগল। সুরমা এক সময় উঁকি দিলেন। চমৎকার সাজানো হয়েছে। জানালায় পর্দা দেয়া হয়েছে। একটা ছোট্ট বুক সেলফ আনা হয়েছে। বুক সেলফ ভর্তি বই। অপালার পড়ার টেবিলটিও আনা হয়েছে। ঘরে। টেবিলে চমৎকার টেবিল ক্লথ। পিরিচ দিয়ে ঢাকা পানির জগ এবং গ্লাস। সুরমা বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপার কী রাত্রি? রাত্রি লজ্জা পেয়ে গেল। তার গাল ঈষৎ লাল হয়ে গেল। এই ক্ষুদ্র পরিবর্তনও সুরমাব চোখ এড়িয়ে গেল না। তিনি হালকা স্বরে বললেন, ছেলেটা হঠাৎ এই পরিবর্তন দেখে কী ভাববে বলত?
কিছুই ভাববেন না। উনি অন্য ব্যাপারে ডুবে আছেন। কিছুই তাঁর চোখে পড়বে না। উনি আছেন একটা ঘোরের মধ্যে।
তুই যা করেছিস চোখে না পড়ে উপায় আছে?
আলমের কিছু চোখে পড়ল বলে মনে হল না। সে সহজভাবেই ভেতরের ঘরে চলে এল। প্রথম কদম ফুল-এর পাতা উল্টাতে লাগল। রাত্রি দাবজাব পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে হাসিমুখে বলল–বইটা কেমন লাগছে?
ভাল।
ছেলেটার ওপর আপনার রাগ লাগছে না?
কোন ছেলেটার ওপর?
কাকলীর হাজবেন্ড।
না, রাগ লাগবে কেন?
আপনার কী আর কিছু লাগবে?
না, কিছু লাগবে না।
ড্রয়ারে মোমবাতি আছে। যদি বাতি নিভে যায় মোমবাতি জ্বালাবেন।
ঠিক আছে, জ্বালাব।
রাত দশটায় মতিন সাহেব আলমকে ডাকতে এলেন ভয়েস অব আমেরিকা শুনবার জন্যে। আলম বলল তার মাথা ধরেছে, সে শুয়ে থাকবে। মতিন সাহেব তাঁবু খানিকক্ষণ ঝুলাঝুলি করলেন। একা একা তার কিছু শুনতে ইচ্ছা করে না। আজ রাত্ৰিও নেই। দবাজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে।
মতিন সাহেব শোবার ঘরে ঢুকলেন। সুষমা জেগে আছে এখনো। আলনায় কাপড় রাখছে। মতিন সাহেব ভয়ে ভয়ে বললেন, সুরমা ভয়েস অব আমেরিকা শুনবে? সুরমা শীতল গলায় বললেন, না।
আজ কিছু ইন্টারেস্টিং ডেভলপয়েন্ট শোনা যাবে বলে আমার ধারণা।
সুরমা জবাব দিলেন না।
আলমের ঘুম ভাঙল খুব ভোরে
আলমের ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। আঁধার তখনো কাটেনি। চারদিকে ভোর হবার আগের অদ্ভুত নীরবতা। কিছুক্ষণের ভেতরই সূর্য উঠার মত বিরাট একটা ঘটনা ঘটবে। প্রকৃতি যেন তার জন্যে প্রস্তুতি নিচেছ। আলম নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামল। প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই চারদিক থেকে আজানের শব্দ হতে লাগল। ঢাকা শহরে এত মসজিদ আছে? আলম হকচকিয়ে গেল; ভোরবেলায় অদ্ভুত অন্ধকারে চারদিক থেকে ভেসে আসা আজনের শব্দে অন্য রকম কিছু আছে। কেমন যেন ভয়ভয় লাগে। আলমের প্রায় সারাজীবন এই শহরেই কেটেছে কিন্তু সকালবেলার এই ছবিব সঙ্গে তার দেখা হয়নি। সব মানুষই বোধ হয়। অনেক কিছু না জেনে বড় হয়।
সুরমা বারান্দায় বসে অজু করছিলেন। আলমকে বেরুতে দেখে বেশ অবাক হলেন। মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে পরিষ্কার গলায় বললেন, রাতে ঘুম হয়নি? তাঁর গলায় খানিকটা উদ্বেগ ছিল। আলমকে তা স্পর্শ করল। সে হাসিমুখে বলল, ভাল ঘুম হয়েছে। খুব ভাল। আপনি কী রোজ এ সময়ে জাগেন?
হ্যাঁ। নামাজ পড়ি। নামাজ শেষ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। তারপর সাতটা সাড়ে সাতটার দিকে রাত্রি ডেকে তোলে।
সুরমা হাসতে লাগলেন। যেন খুব একটা হাসির কথা বলেছেন। ভোরবেলার বাতাসে কিছু একটা বোধ হয় থাকে। মানুষকে তরল করে ফেলে। আলম বলল, আজ আমাদের একটা বিশেষ দিন।
বুঝতে পারছি। তোমার কী ভয় লাগছে?
ভয় না। অন্য রকম লাগছে। আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারব না। মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম ঘণ্টা পড়বার সময় যে রকম লাগে। সে রকম।
কিন্তু এ ধরনের কাজ তো তুমি এর আগেও করেছ।
তা করেছি। অবশ্যি এখানকার অবস্থাটা অন্য রকম।
তুমি কী আল্লাহ বিশ্বাস করা তোমার বয়েসী যুবকরা খানিকটা নাস্তিক ধরনের হয় সেই জন্যে বলছি।
আলম কিছু বলল না। সুরমা তার প্রশ্নের জবাবের জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। জবাব পেলেন না। তিনি হালকা গলায় বললেন, নামাজ শেষ করে এসে আমি একটা দোয়া পড়ে তোমার মাথায় ফুঁ দিতে চাই। তোমার কোনো আপত্তি আছে?