সাদেক দুপুর তিনটা পর্যন্ত থাকল। মৃদু গলায় প্ল্যান নিয়ে কথা বলল। প্রথম দিনের অপারেশনের জায়গাগুলি ঠিক করল। রেকি করবার কি ব্যবস্থা করা যায় সে নিয়ে কথা বলল। অপারেশন চালাতে হবে অচেনা গাড়ি দিয়ে। সেই গাড়ির জোগাড় কিভাবে করা যায়। সেই নিয়েও কথা হল। আগামীকাল ভোরে আবার বসতে হবে। এ বাড়িতে নয়। পাক মটরস-এর কাছের একটি বাড়িতে। সেখানে রহমানও থাকবে। প্রোগ্রাম ফাইন্যাল করা হবে সেখানেই।
সাদেক যাবার আগে সুরমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। সুরমা হকচাকিয়ে গেলেন।
দোয়া করবেন খালাম্মা।
হ্যাঁ নিশ্চয়ই দোয়া করব।
রাত্রিকে ডাকুন। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাই।
রাত্রি এল। খুব সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সাদেক বলল, রাত্ৰি চলি। আবার দেখা হবে। যেন এ বাড়ির সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের চেনাজানা। রোজই আসছে, যাচ্ছে। রাত্ৰি হেসে ফেলে বলল, হ্যাঁ নিশ্চয়ই দেখা হবে। ভাল থাকবেন।
সাদেক ঘর থেকে বেরুবামাত্র রাত্রি বলল, আপনার বন্ধুর সঙ্গে আপনার কোন মিল নেই। দু’জন সম্পূর্ণ দুরকম। ও কী আপনার খুব ভাল বন্ধু?
হ্যাঁ ভাল বন্ধু। ও কিন্তু একটি অসম্ভব ভাল ছেলে।
তা জানি।
কিভাবে জানেন?
কিছু কিছু জিনিস টের পাওয়া যায়। আপনার হয়ত ধারণা হয়েছে। আমি উনার ওপর বিরক্ত হয়েছি। এটা ঠিক না। আমি বিরক্ত হইনি।
অনেক দিন পর আলম দুপুর বেলা ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যা মিলাবার পর। বিন্তি চায়ের পেয়ালা হাতে তাকে ডাকছে। বাইরে প্রবল বর্ষণ। ঘোর বর্ষা যাকে বল। মতিন সাহেব বসে আছেন সোফায়। তাকে কেমন যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে। আলম উঠে বসতেই তিনি বললেন, শরীর খারাপ করেছে নাকি?
জি না।
হাত-মুখ ধুয়ে আস। একটা খারাপ খবর আছে।
কী সেটা?
আমেরিকানরা সেভেনথ ফ্লিট নিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হয়েছে।
আলম এই খবরে তেমন কোনো উৎসাহ দেখাল না। তার কাজকর্মের সঙ্গে আমেরিকান সেভেনথ ফ্লিটের কোন সম্পর্ক নেই। মতিন সাহেব নিচু গলায় বললেন, এর চেয়েও একটা খারাপ সংবাদ আছে।
বলুন শুনি।
ঢাকা শহরে চাইনজি সোলজার দেখা গেছে।
আপনি নিজে দেখেছেন?
না, আমি নিজে দেখিনি। কিন্তু দেখেছেন অনেকেই। নাক চেঁপা বাঁটু সোলজার। দেখলেই চেনা যায়।
আলম বাসিমুখে চায়ে চুমুক দিতে লাগল। গুজবে ভর্তি হয়ে গেছে। ঢাকা শহর। মানুষের মরাল ভেঙে পড়ছে। ঢাকা শহরের গেরিলাদের প্রথম কাজই হবে এই মরাল ঠিক করা। নতুন ধরনের গুজবের জন্ম দেয়া। যা শুনে একেকজনেব বুকেব ছাতি ফুলে উঠবে। এবা রাতে আশা নিযে ঘুমুতে যাবে। মতিন সাহেবের মত প্রাণহীন মুখ করে সোফায় বসে থাকবে না।
আলম।
বলুন।
শুনলাম তোমার এক বন্ধু নাকি এসেছিল?
জি।
কাজ তাহলে শুরু হচ্ছে?
হচ্ছে।
অবস্থা কাহিল হয়ে যাবে ওদের, কী বল?
তা হবে।
এক লাখ নতুন কবর হবে, কী বল? :
হওয়ার তো কথা।
যশোহরের এক পীর সাহেব কী বলেছেন শুনবে কী?
বলুন।
খুবই কামেল আদমি। সুফী মানুষ।
মতিন সাহেব অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে যশোবের পীর সাহেবের কথা বলতে লাগলেন। আলম কোনো কথা না বলে গল্প শুনে গেল। ডুবন্ত মানুষরাই খড়কুটো আঁকড়ে ধরে। ঢাকার মানুষ কী ডুবন্ত মানুষ? তারা কেন এ রকম করবে? আলম একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস চাপতে চেষ্টা করল।
রাত্রির ঘর অন্ধকার। সে বাতি নিভিয়ে চুপচাপ শুয়েছিল। অপালা এসে বলল, ফুফু টেলিফোন করেছে। তোমাকে ডাকে। রাত্রি একবার ভাবল টেলিফোন ধরবে না। বলে পাঠাবে শবীর ভাল না, জ্বরজ্বর লাগছে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। ফুফু বলবেন রিসিভার এ ঘরে নিয়ে আসতে। তার চেয়ে টেলিফোন ধরাই ভাল।
কেমন আছিস রাত্রি?
ভাল।
তোদের ইউনিভার্সিটি নাকি খুলেছে? ক্লাস-টাস হচ্ছে?
হ্যাঁ হচ্ছে।
তুই যাচ্ছিস না?
না। পরীক্ষা নাকি ঠিকমত হবে শুনলাম?
হলে হবে।
তোর গলাটা এত ভারী ভারী লাগছে কেন? জ্বর নাকি?
না, জ্বর না।
কাল গাড়ি পাঠাব। চলে আসবি আমার এখানে।
আচ্ছা।
আরেকটা কথা শোন, ঐ ভদ্রমহিলা আসবেন তোকে দেখতে। দেখলেই যে বিয়ে হবে এমন তো কোনো কথা না। তোর মত মেয়েকে কি কেউ জোর করে বিয়ে দিতে পারে? তোর অনিচ্ছায় কিছু হবে না। বুঝতে পারছিস?
পারছি।
কাজেই ভদ্রমহিলা এলে স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলবি।
ঠিক আছে বলব।
রাত্রি আরেকটা কথা শোন–আমাদের ড্রাইভার বলল সে দেখেছে কে একজন লোক তোদের বসার ঘরের ক্যাম্প খাটে শুয়ে আছে। কে সে?
আব্বার এক বন্ধুর ছেলে।
এখানে সে কী করছে?
কি একটা কাজে ঢাকায় এসেছে। থাকার জায়গা নেই। বুধবারে চলে যাবে।
নাসিমা বিরক্ত স্বরে বললেন– থাকার জায়গা নেই মানে? হোটেল আছে কী জন্যে? বাড়িতে সেয়ানা মেয়ে। এর মধ্যে ছেলে-ছোকরা এনে ঢুকানোর মানেটা কী? দেখি তোর বাবাকে টেলিফোনটা দে তো।
মতিন সাহেব টেলিফোনটা ধরতে রাজি হলেন না। কারণ তিনি বিবিসি শুনছেন। এই অবস্থায় তাকে হাতী দিয়ে টেনেও কোথাও নেয়া যাবে না। বিবিসি একটা বেশ মজার খবর দিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আমেরিকান টিভি এনবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন–আলোচনার দ্বার রুদ্ধ নয়। এর মানে কী? কী আলোচনা? কার সঙ্গে আলোচনা? হাতী কী কাদায় পড়ে গেছে নাকি? এটেল মাটির কাদা। মতিন সাহেব অনেক দিন পর ঢাকা রেডিও খুললেন। মাঝে-মধ্যে এদের কথাও শোনা দরকার। তেমন কোনো খবর নেই। দেশে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নের কারণে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন শান্তি ও কল্যাণ কমিটির সভাপতি ফরিদ আহমেদ। মুসলিম লীগের সভাপতি হাশিমউদ্দীনের বিবৃতিও খুব ফলাও কবে প্রচার করা হল – ছাত্র-ছাত্রীরা যেন দেশদ্রোহীদের দুরভিসন্ধিমূলক ও মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হয়। তারা যেন একটি মূল্যবান শিক্ষাবছর নষ্ট না করে। শান্তিপূর্ণভাবে মেট্রিক পরীক্ষা পরিচালনার জন্যে সরকার যা করণীয় সবই করবেন।