আলম হোসে ফেলল। শরীফ সাহেব রেগে গেলেন। মানুষটি ছোটখাটো। ফাইন্যান্সের জয়েন্ট সেক্রেটারি। যতটা না বয়েস তার বেয়েও বুড়ো দেখাচ্ছে। মাথার সমস্ত চুল পেকে গেছে। মুখের চামড়ায় ভাজ পড়েছে। আলম বলল মামা, বাসার খবর তো এখনো দিলে না। ওরা কেমন আছে?
ভালই।
মা’র শরীর কেমন?
শরীর ঠিকই আছে। শরীর একটা আশ্চর্য জিনিস, এটা ঠিকই থাকে।
তোমার তো তাও ঠিক নেই মামা, বুড়ো হয়ে গেছ।
তা হয়েছি। একা থাকি। রাতে ঘুম-টুম হয় না।
আমাদের বাড়িতে গিয়ে থাকলেই পাের।
পাগল হয়েছিস। ঐ বাড়ির ওপর নজর রাখছে না। তুই যুদ্ধে গেছিস সবাই জানে। তোর মাকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
আর কোনো ঝামেলা করেনি?
করত। তোর বাবার জন্যে বেঁচে গেলি! ভাগ্যিস সে মরবার আগে ‘তমঘায়ে খিদমত’টা পেয়েছিল।
শরীফ সাহেব শার্ট গায়ে দিলেন। জুতো পরলেন।
যাচ্ছে কোথায় মামা?
অফিসে। আর কোথায় যাব? তুই কি ভেবেছিলি – যুদ্ধে যাচ্ছি?
অফিস-টফিস করছি ঠিকমতই?
করব না? তোর মত কয়েকজন চেংড়া ছোড়া দু’একটা গুলি-টুলি করবে। আর এতেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে? দিল্লি হনুজ দূরঅস্ত। তাছাড়া পলিটিক্যাল সলুশন হয়ে যাচ্ছে। খুব হাই লেভেলে কথাবার্তা হচ্ছে। আমেরিকা চাপ দিচ্ছে। আমেরিকার চাপ কি জিনিস তোরা বুঝবি না। স্যাকরার ঠিকঠাক কামারের এক ঘা।
আলম হাসতে লাগল। এই মামার সঙ্গে তার খুবই ভাব। একজন সৎ এবং সত্যিকার অর্থে ভাল মানুষ। তাঁর একটি মাত্র দোষ–উল্টো তর্ক করা। আলমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু এই তিনিই আবার পাকিস্তানি ভাব আছে এমন কারোর সঙ্গে কথা বলবার সময় এমন যুক্তি দেবেন যাতে মনে হবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দেশ স্বাধীন হচ্ছে।
আলম।
জি।
তোর মার সঙ্গে দেখা করবি না?
না।
ভাল। লায়েক ছেলে তুই! যা ভাল মনে করিস তাই করবি। আমার এখানে থাকতে চাস?
না।
তোর কি ধারণা আমার এখানে উঠলেই তোকে আমি মিলিটারির হাতে ধরিয়ে দেব?
তোমাদের কোনো ঝামেলায় ফেলতে চাই না।
এসেছিস কী জন্যে আমার কাছে?
দেখতে এলাম।
যা দেখার ভাল করে দেখে নে। দশ মিনিট সময়। দশ মিনিটের মধ্যেই বেরুব।
আলম উঠে দাঁড়াল। শরীফ সাহেব বললেন, তুই কোথায় আছিস ঠিকানাটা রেখে যা।
ঠিকানা দেয়া যাবে না মামা। মাকে বুলবে। আমি ভাল আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব।
আমি বললে বিশ্বাস করবে না। তুই মরে গেছিস এটা বললে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করবে, বেঁচে আছিস বললে করবে না। তুই একটা কাজ কর, একটা কাগজে লেখ–আমি ভাল আছি। তারপর নাম সই করে দে। আজকের তারিখ দিবি।
আলম লিখল–ভাল আছি মা। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লিখল, শিগগির তোমাকে দেখতে আসব। দ্বিতীয় লাইনটি লিখে তার একটু খারাপ লাগতে লাগল। শিগগিরই তোমাকে দেখতে আসব। এই লাইনটিতে কোথায় যেন একটু বিষাদের ভাব আছে। দেখতে আসা হবে না। এই কথাটি যেন এর মধ্যে লুকানো।
শরীফ সাহেব গন্ত্রীর গলায় বললেন, একটা লাইন লিখতে গিয়ে বুড়ো হয়ে যাচ্ছিস দেখি। তাড়াতাড়ি কর।
আলম কাগজটা মামার হাতে ধরিয়ে নিউ পল্টনে চলে এল। বসবার ঘরে সাদেক তার জন্যে অপেক্ষা করছে।
সাদেককে কেমন অচেনা লাগছে।
ফর্সা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একজন মানুষ। সে গোঁফ ফেলে দিয়েছে। লম্বা চুল ছিল। সেগুলি কেটেছে। জুতো জোড়াও চক চক করছে। আলম বলল, খোলস পাল্টে ফেলেছিস মনে হচ্ছে। চেনা যাচ্ছে না।
ঢাকা শহরে ঢুকলাম এতদিন পর। সেজোগুজে ঢুকব না? তুই ছিলি কোথায়? দেড় ঘণ্টা ধরে এক জায়গায় বসে আছি।
আজ আসবি বুঝব কী করে? আমি তো ভাবলাম প্রোগ্রাম ক্যানসেল। সব বাতিল।
ক্যানসোল হওয়ার মতই।
কী বললি?
রহমানের খোঁজ নেই। নো ট্রেস।
নো ট্রেস মানে?
নো ট্রেস মানে নো ট্রেস। সে আমার সঙ্গেই ঢাকায় ঢুকেছে। তারপর যেখানে যাবাব কথা সেখাদ্যযন্ধু, কোথায় আছে তাও কেউ জানে না। একগাদা এক্সপ্লোসিভ তার সাথে।
বলিস কী?
আমার আক্কেল গুডুম হয়ে গিয়েছিল। ডুব মারলাম। তিনদিন ডুব দিয়ে থাকার পর গেলাম ঝিকাতলা। কনটাক্ট পয়েন্টে। সেখানেও ভোঁ ভোঁ। কেউ নেই।
এখন ব্যাপারটা কোন পর্যায়ে আছে?
বলছি। তার আগে বাথরুমে যাওয়া দরকার। কিডনি ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। হেভি প্রেসার।
আলম ইতস্তত করে বলল, এখানে বাথরুমের একটু অসুবিধা আছে। বাইরে চলে যা, রাস্তার পাশে কোথাও বসে পড়। সাদেক বেরিয়ে গেল। এ বাড়িতে এসে সে খানিকটা ধাঁধায় পড়ে গেছে। দেড় ঘণ্টা একা একাই বসে ছিল। এর মধ্যে ঘোমটা দেয়া এক মহিলা এসে বললেন, আলম বাইরে গেছে। এসে পড়বে। তুমি বস। এ রকম শীতল কণ্ঠ সাদেক এর আগে শোনেনি। যেন একজন মরা মানুষ কথা বলছে।
প্রায় আধঘণ্টা পর বাইশ-তেইশ বছর বয়েসী চকলেট রঙ শাড়ি পরা একটি মেয়ে এসে ঢুকল এবং সরু চোখে তাকিয়ে রইল। এ রকম রূপবতী মেয়েদের সাধারণত সিনেমা পত্রিকার কভারে দেখা যায়। বাড়িতে তাদের দেখতে পাওয়ার কথা নয়। সাদেক ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কিছু বলবেন আমাকে? মেয়েটি তার মার মত শীতল গলায় বলল, আপনি কী দুপুরে এখানে খাবেন?
কি অদ্ভুত কথা। অচেনা, অজানা একটা মানুষকে কেউ এভাবে বলে নাকি? সাদেক অবশ্যি নিজেকে চট করে সামলে নিয়ে বলল, জি খাব। দুপুরে কী রান্না হচ্ছে?
মেয়েটি এই কথার জবাব দেয়নি। ভেতরে চলে গেছে। তারপর খাটাং খটাং শব্দ। সেলাই মেশিন চলতে শুরু করেছে। মেয়েটি চায়ের কাপ নিয়ে এসেছে কিছুক্ষণ পর। কাপ নামিয়ে বলেছে। চিনি লাগবে কিনা বলুন।