রাত্রি হেসে ফেলল। বাবা এমন ছেলেমানুষি বিশ্বাস নিয়ে কথা বলেন যে বড় মায়া লাগে। মাঝে মাঝে রাত্ৰি ভাবতে চেষ্টা করে এ দেশে এমন কেউ কি আছে যে এই দেশকে তার বাবার চেয়ে ভালবাসে?
বাবা।
কী?
শুয়ে পড় বাবা। ঘুমাও।
ঘুম ভাল হয় না রে মা। সব সময় একটা আতংকের মধ্যে থাকি।
একদিন এই আতংক কেটে যাবে। আমরা সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমুব।
মতিন সাহেবের চোেখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি গলার স্বর অনেকখানি নিচে নামিয়ে বললেন, আমাদের বাসায় যে ছেলেটা আছে সে কে বল তো মা? দেখি তোর কেমন বুদ্ধি।
রাত্রি চুপ করে রইল। মতিন সাহেব ফিসফিস করে বললেন, বলতে পারলি না? জানি পারবি না। ও হচ্ছে সাক্ষাৎ আজাদহা, আবাবিল পক্ষী। ছারখার করে দিবে। কিছু বুঝতে পারলি?
পারছি।
দেখে মনে হয়?
আমার সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি।
কথা বলে দেখ, মনে হবে সাধারণ বাঙালি ঘরের ছেলে।
উনি তো বাঙালি ঘরের ছেলেই বাবা।
আরে না। ছেলেতে ছেলেতে ডিফারেন্স আছে না? এরা হচ্ছে সাক্ষাৎ আজাদহা।
আজাদহাটা কি?
মতিন সাহেব জবাব দিতে পারলেন না। আজাদহা কি সে সম্পর্কে তার ধারণা স্পষ্ট নয়। কথাটা তিনি অফিসে শুনেছেন। গেরিলা প্রসঙ্গে কে যেন বলেছিল – তার খুব মনে ধরেছে।
রাত্রি বলল, বাবা, তুমি কি ইনার কথা কাউকে বলেছ?
আরে না। কি সর্বনাশ! কাউকে বলা যায় নাকি?
তুমি তো পেটে কথা রাখতে পার না বাবা। এই তো আমাকে বলে ফেললে।
তিনি চুপ করে গেলেন। রাত্রি বলল, ভাল করে মনে করে দেখ, কাউকে বলনি?
না।
তোমাদের ক্যাশিয়ার সাহেব, তাঁকেও না?
না।
বাবা, ভাল করে ভেবে দেখ। জানাজানি হলে বিরাট বিপদ হবে।
আরে না। তুই পাগল হলি নাকি?
দুধ খাবে বাবা? শোবার আগে এক গ্লাস গরম দুধ খেয়ে শোও। ভাল ঘুম হবে। দুধ না, চা খেতে ইচ্ছা করছে। তোর মাকে না জাগিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে দে।
রাত্রি উঠে দাঁড়াল।
আলম হকচাকিয়ে গেল।
প্ৰায় মাঝরাতে এমন একটি রূপবতী মেয়ে অসংকোচে তার সামনে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখবে এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই মেয়েটি রাত্রি, এটা বোঝা যাচ্ছে কিন্তু তার কাণ্ডকারখানা বোঝা যাচ্ছে না। রাত্রি মৃদু স্বরে বলল, বাবার জন্যে চা বানাতে হল। আপনি জেগে আছেন, তাই আপনার জন্যেও বানালাম। ঠিক কি বললে ভাল হয় আলম বুঝতে পারল না। মেয়েটি চলেও যাচ্ছে না। তাকে কী বসতে বলা উচিত? কিন্তু এটা তারই বাড়ি। তার বাড়িতে তাকে বসতে বলার মানে হয় না।
আমি এ বাড়ির বড় মেয়ে। আমার নাম রাত্রি।
আপনি কেমন আছেন?
আপনি কেমন আছেন বলে আলম আরো অস্বস্তিতে পড়ল। বোকার মত একটি প্রশ্ন করা হয়েছে। এবং মেয়েটি তা পরিষ্কার বুঝতে পারছে। কারণ সে এই প্রশ্নের কোন জবাব দেয়নি। আলমের মনে হল মেয়েটি যেন একটু হাসল।
রাত্রি বলল, আপনি কী আমার ওপর রাগ করেছিলেন?
রাগ করব কেন?
বিকেলে বাবা আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিল তখন আসিনি সে জন্যে।
আরে না। ঐসব নিয়ে আমি ভাবিইনি।
আমার মন খারাপ ছিল তখন, তাই আসিনি। আমার ফুফুর ওপর রাগ করেছিলাম।
ও আচ্ছা।
আপনি বোধ হয় চা-টা খাবেন না। দিন নিয়ে যাই।
না। আমি খাব।
আলম চায়ে চুমুক দিল। রাত্রি বলল–কিছু বলবেন না?
কি বলব?
ভদ্রতা করে কিছু বলা। যেমন চা-টা খুব ভাল হয়েছে এ জাতীয়।
রাত্রি হাসছে। আলম ধাঁধায় পড়ে গেল। এই বয়েসী মেয়েদের সঙ্গে তার কথা বলার অভ্যেস নেই। খুবই অস্বস্তি লাগছে। সে বুঝতে পারছে তার গাল এবং কান লাল হতে শুরু করেছে। ইচ্ছে করছে এ জায়গা থেকে কোনোমতে ছুটে পালিয়ে যেতে এবং একই সঙ্গে মনে হচ্ছে এই মেয়েটি এক্ষুণি যেন চলে না যায়। যেন সে থাকে আরো কিছুক্ষণ। আলমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল।
রাত্রি বলল, যাই। আপনি শুয়ে পড়ুন।
আলম অনেক রাত পর্যন্ত চুপচাপ বসে রইল। অদ্ভুত এক ধরনের কষ্ট হতে লাগল তার। এই কষ্টের জন্ম কোথায় তার জানা নেই।
রাত বাড়ছে। চারদিক চুপচাপ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবারো হয়ত ঝড়-বৃষ্টি হবে। হোক, খুব হোক। সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাক।
আলম বাতি নিভিয়ে দিল। আজ রাতেও ঘুম আসবে না। জেগে কাটাতে হবে। ঢাকায় আসার পর থেকে এমন হচ্ছে। কেন হচ্ছে? আগে তো কখনো হয়নি। সে কি ভয় পাচ্ছে? ভালবাসা, ভয়, ঘৃণা, এসব জিনিসের জন্ম কোথায়?
তার পানির পিপাসা হল। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না।
শরীফ সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন
শরীফ সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। নিজের চোখকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। আলম বলল, কথা বলছি না কেন মামা? কেমন আছ?
ভাল আছি। তুই কোথেকে। বেঁচে আছিস এখনো?
আছি। বাসা অন্ধকার কেন? মামি কোথায়?
দেশের বাড়িতে। তুই এখন কোনো প্রশ্ন কববি না। কিছুক্ষণ সময় দে নিজেকে সামলাই।
শরীফ সাহেব সোফায় বসে সত্যি সত্যি বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। আলম বলল, বাসার খবর বল। সবাই আছে কেমন?
তুই বাসায় যাসনি?
না।
সরাসরি আমার এখানে এসেছিস?
তাও না। ঢাকাতেই আছি কয়েকদিন ধরে।
তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
ঢাকায় আমি একটা কাজ নিয়ে এসেছি মামা।
আই সি।
এখন বল বাসার খবর।
বাসার খবর তোকে কেন বলব? তোর কী কোন আগ্রহ আছে, না কোন দায়িত্বজ্ঞান আছে? বোন আর মাকে ফেলে চলে গেলি দেশ উদ্ধারে। ওদের কথা ভাবলি না?
তোমরা আছে, তোমরা ভাববে।
প্রথম রেসপনসিবিলিটি হচ্ছে নিজের পরিবারের জন্যে। এই সাধারণ কথাটা তোরা কবে বুঝবি?