- বইয়ের নামঃ আগুনের পরশমণি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধের-বই
সারাটা সকাল উৎকণ্ঠার ভেতর কাটল
সারাটা সকাল উৎকণ্ঠার ভেতর কাটল। উৎকণ্ঠা এবং চাপা উদ্বেগ। মতিন সাহেব অস্থির হয়ে পড়লেন। গোটে সামান্য শব্দ হতেই কান খাড়া করে ফেলেন, সরু গলায় বলেন, –বিন্তি দেখ তো কেউ এসেছে কী-না।
বিন্তি এ বাড়ির নতুন কাজের মেয়ে। তার কোন ব্যাপারে কোন উৎসাহ নেই, কিন্তু গেট খোলায় খুব আগ্রহ। সে বারবার যাচ্ছে এবং হাসিমুখে ফিরে আসছে। মজার সংবাদ দেয়ার ভঙ্গিতে বলছে, বাতাসে গেইট লড়ে। মানুষজন নাই। দুপুরের পর মতিন সাহেবের উদ্বেগ আরো বাড়ল। তিনি তলপেটে একটা চাপা ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। এই উপসর্গটি তাঁর নতুন। কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত হলেই তলপেটে তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা হতে থাকে। ডাক্তার-টাক্তার দেখানো দরকার বোধ হয়। আলসার হলে কী এরকম হয়? আলসার হয়ে গেল নাকি?
মতিন সাহেব পাঞ্জাবি গায়ে দিলেন। চুল আঁচড়ালেন। সুরমা অবাক হয়ে বললেন, কোথায় যাচ্ছ তুমি?
এই একটু রাস্তায়।
রাস্তায় কী?
কিছু না। একটু হাঁটর আর কি।
তিনি হাসতে চেষ্টা করলেন।
সুরমার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। গত রাতে তাদের বড় রকমের একটা ঝগড়া হয়েছে। সাধারণত ঝগড়ার পর তিনি কিছুদিন স্বামীর সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। আজ তার ব্যতিক্রম হল। তিনি কঠিন গলায় বললেন, তুমি সকাল থেকে এ রকম করছি কেন? কারোর কী আসার কথা?
মতিন সাহেব পাংশু মুখে বললেন–আরে না, কে আসবে? এই দিনে কেউ আসে?
মতিন সাহেব স্ত্রীর দৃষ্টি এড়াবার জন্যে নিচু হয়ে চটি খুঁজতে লাগলেন। সুরমা বললেন, রাস্তায় হাঁটাহাটির কোনো দরকার নেই। ঘরে বসে থাক।
যাচ্ছি না কোথাও। এই গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব।
গেটের বাইরে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকবে কেন?
তিনি জবাব দিলেন না।
স্ত্রীর কথার অবাধ্য হবার ক্ষমতা তার কোনো কালেই ছিল না। কিন্তু আজ অবাধ্য হলেন। হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবি গায়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। রাস্তা ফাঁকা। তিনি পরপর দু’টি সিগারেট শেষ করলেন। এর মধ্যে মাত্র একটা রিকশা গেল। সে রিকশাও ফাঁকা। অথচ কিছুদিন আগেও দুপুর বেলায় রিকশার যন্ত্রণায় হাঁটা যেত না। মতিন সাহেব রাস্তার মোড় পর্যন্ত গেলেন। ইন্দ্রিস মিয়ার পানের দোকানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। ইদ্রিস মিয়া শুকনো গলায় বলল, স্যার ভাল আছেন?
তিনি মাথা নাড়লেন। যার অর্থ হ্যাঁ। কিন্তু মুখের ভাবে তা মনে হল না। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি ভাল নেই।
বিক্রিবাটা কেমন ইদ্রিস?
আর বিক্রি। কিনব কে কেন? কিনার মানুষ আছে?
দেখি একটা পান দাও।
মতিন সাহেবের এখনো দুপুরে খাওয়া হয়নি। এক্ষুণি গিয়ে ভাত নিয়ে বসতে হবে। পান। খাওয়ার কোনো মানে হয় না। কিন্তু একটা দোকানের সামনে শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। ব্যাপারটা সন্দেহজনক। এখন সময় খারাপ। আচার-আচরণে কোন রকম সন্দেহের ছাপ থাকা ঠিক না।
জর্দা দিমু?
দাও।
ইদ্রিস নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে পান সাজাতে লাগল। তার মাথায় ঝুটিবিহীন একটা লাল ফেজ টুপি। কোথেকে জোগাড় করেছে কে জানে। চিবুকের কাছে অল্প দাড়ি। মতিন সাহেব পান মুখে দিয়ে বললেন–দাড়ি রাখছি নাকি ইদ্রিস? ইদ্রিস। জবাব দিল না।
দাড়ি রেখেই ভাল করেছ। যে দিকে বাতাস সেই দিকে পাল তুলতে হয়। পান কত?
দেন যা ইচ্ছা।
ইদ্রিসের গলার স্বরে স্পষ্ট বৈরাগ্য। যেন পানের দাম না দিলেও তার কিছু আসে যায় না। মতিন সাহেব একটা সিকি ফেলে খানিকটা এগিয়ে গেলেন। নিউ পল্টন লাইনের এই গলিটায় বেশ কয়েকটি দোকান। কিন্তু মডার্ন সেলুন এবং পাশের ঘরটি ছাড়া সবই বন্ধ। তিনি মডার্ন সেলুনে ঢুকে পড়লেন। রাস্তায় হাঁটাহঁটি করবার চেয়ে সেলুনে চুল কাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকা ভাল। সেলুনটা এক সময় মস্তান ছেলেপুলেদের আড্ডাখানা ছিল। লম্বা চুলের চার-পাঁচটা ছেলে শার্টের বুকের বোতাম খুলে বেঞ্চির ওপর বসে থাকত। সেলুনের একটা এক ব্যান্ড ট্রানজিস্টার সারাক্ষণই বাজত। ট্রানজিস্টারের ব্যাটারির খরচ দিতে গিয়েই সেলুনের লাটে উঠার কথা। কিন্তু তা ওঠেনি। রমরমা ব্যবসা করছে। আজ অবশ্যি জনশূন্য। তবে ট্রানজিস্টার বাজছে। আগের মত ফুল ভলু্যমে নয়। মৃদু শব্দে। দেশাত্মবোধক গান। কথা ও সুর নজিবুল হক। মতিন সাহেব বেশ মন দিয়েই গান শুনতে লাগলেন। তবে চোখ রাখলেন রাস্তাব উপর।
চুলটা একটু ছোট কর।
নাপিত ছেলেটি বিস্মিত হল। সে ইনার চুল গত বুধবারেই কেটেছে। আজ আবেক বুধবাব। এক সপ্তাহে চুল বাড়ে দুই সুতা। তার জন্যে কেউ চুল কাটাতে আসে না।
স্যার চুল কাটাবেন?
কুঁ। পিছনের দিকে একটু ছোট কবি। কী নাপিতেব কাচি যন্ত্রের মত খটখট করতে লাগল। মতিন সাহেব বললেন–দেশের হালচাল কী?
ভালই।
চুল কাটতে এলে এই ছোকরার কথার যন্ত্রণায় অস্থির হতে হয়। কথা শুনতে তার খারাপ লাগে না। কিন্তু এই ছোকরা কথা বলার সময় থুথুর ছিটা এসে লাগে। আজ সে নিশূচুপি। থুথু গায্যে লাগাব কোন আশংকা নেই।
দাম দেবার সময় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, রাতদিন ট্রানজিস্টার চালাও কিভাবে? ব্যাটাবিব তো মেলা দাম। নাপিত ছোকরা জবাব দিল না। গম্ভীর মুখে টাকা ফেবত দিয বেঞ্চিব উপর পা তুলে বসে রইল। মতিন সাহেব বললেন, আজ কার্ফু কটা থেকে জানো নাকি?