ফখরুদিন সাহেব লন্ডনের সাবার্বে লাল ইটের ছোটখাটো একটি নার্সিং হোম খুঁজে বের করলেন। এই হাসপাতালটি ঘরোয়া ধরনের। সবার প্রাণপণ চেষ্টা, যেন হাসপাতাল মনে হয় না। কিছু অংশে তারা সফল। চট করে এটাকে হাসপাতাল মনে হয় না। তবে তার জন্যে রুগীদের প্রচুর টাকা দিতে হয়। এখানে বড় হাসপাতালের খরচের দেড়গুণ বেশি খরচ হয়। টাকাটাও আগেভাগেই দিতে হয়। ভালই লাগে। ফখরুদ্দিন সাহেব নিজে যখন দরিদ্র, তখনো তার এই স্বভাব ছিল। পড়াশোনার খরচ দিতেন বড়মামা। তাঁর অবস্থা নড়বড়ে ছিল, তবু তিনি মাসের তিন তারিখে একটা মানিঅৰ্ডার পাঠাতেন। প্রায়ই এমন হয়েছে, মাসের ছতারিখেই সব শেষ। তখন ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি। ফখরুদ্দিন সাহেবের জীবনের উদ্দেশ্য ছিল একটিই প্রচুর টাকা রোজগার করা, যাতে দুহাতে খরচ করেও শেষ করা না যায়। ফখরুদ্দিন সাহেবের মেধা ছিল। ভাগ্যও প্রসন্ন ছিল। মাত্র পঁয়ত্ৰিশ বছর বয়সে ব্যবসা জমিয়ে ফেললেন। চারদিক থেকে টাকা আসতে শুরু করল। বিয়ে করলেন সাইঁত্রিশ বছর বয়সে। বাসর রাতে স্ত্রীকে বললেন, টাকাপয়সা তোমার কাছে কেমন লাগে?’
হেলেনার বয়স তখন মাত্র সতের। আই.এ পরীক্ষা দিয়ে বড় ফুপার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। সেখানেই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বিয়ে। বাসর রাতে টাকা প্রসঙ্গে স্বামীর এই অদ্ভুত প্রশ্নের সে কোনো আগামাথা পেল না। সে চুপ করে রইল। ফখরুদ্দিন সাহেব অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে–টু বিকাম রিচ। ভেরি রিচ। টাটা-বিড়ালদের মত। তোমার কি ধারণা, আমি পারব?
হেলেনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার কেন জানি মনে হতে লাগল, এই লোকটি ঠিক সুস্থ নয়। সুস্থ মানুষ বিয়ের প্রথম রাত্রে স্ত্রীকে নিশ্চয়ই এ জাতীয় কথা বলে না।
বুঝলে হেলেনা, আমার মনে হয়। আমি পারব। আমি খুব দ্রুত ভাবতে পারি। ভবিষ্যৎ চোখের সামনে দেখতে পাই। এটা মেজর এ্যাডভানটেজ। অন্যরা যা আজ চিন্তা করে, আমি সেটা দুবছর আগেই চিন্তা করে রেখেছি।
হেলেনার বিয়ে হয়েছিল শ্রাবণ মাসে। হুঁট করে বিয়ে। আত্মীয়স্বজন দূরের কথা, নিজের মা পর্যন্ত খবর জানেন না। টেলিগ্রাম করা হয়েছে, এখনো হয়তো পৌঁছেনি। ঘটনার আকস্মিকতা, বিয়ের উত্তেজনায় এমনিতেই হেলেনার মাথার ঠিক নেই, তার ওপর লোকটি ক্রমাগত কী-সব বলে যাচ্ছে!
হেলেনা।
জি।
আমি আজ কিঞ্চিৎ মদ্যপান করেছি, যেটা আমি কখনো করি না। আজ বাধ্য হয়ে নাৰ্ভ স্টেডি রাখার জন্যে করতে হল। তুমি সম্ভবত গন্ধ পাচ্ছ।
হেলেনা কোনো গান্ধটন্ধ পাচ্ছিল না। এখন পেতে শুরু করল। তার ইচ্ছে করল চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে।
এই পৃথিবীতে আমি মোটামুটিভাবে একা। মানুষ করেছেন বড়মামা। তাঁর সঙ্গে কিছুদিন আগে বিরাট একটা ঝগড়া হয়েছে। আজ তোমাকে বলব না, পরে বলব। আজ বরং আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলি তোমাকে বলি।
কুম-কুম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। ফখরুদ্দিন সাহেব হাতে সিগারেট ধরিয়ে চক্রাকারে হাঁটছেন এবং কথা বলছেন। সিগারেটের ধোঁয়ায় হেলেনার ওঠে।
দম বন্ধ হবার জোগাড়। লোকটি একটির পর একটি সিগারেট ধরাচ্ছে। পুরোটা টানছে না, কয়েকটি টান দিয়েই ফেলে দিচ্ছে। হেলেনার ভয় ভয় করতে লাগল। এ-কেমন ছেলে! কার সঙ্গে তার বিয়ে হল?
এখনকার ট্রেন্ডটা হচ্ছে কি, জান? চট করে ইন্ডাসট্রি দিয়ে দেয়া। এতে সমাজে প্রেস্টিজ পাওয়া যায়। লোকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। কিন্তু এসব ইন্ডাস্ট্রি শেষপর্যন্ত হাতিপোষার মতো হয়। হাতির খাবার জোগাতে গিয়ে প্রাণান্ত। বুঝতে পারছি, কী বলছি?
না।
র মেটিরিঅ্যাল নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। ইন্ডাস্ট্রির খাবার হচ্ছে র মেটিরিঅ্যাল, যার প্রায সবই আনতে হয়। বাইরে থেকে। আমি তা করব না। আমি যখন কোনো ইন্ডাস্ট্রি দেব তার প্রতিটি বা মেটেরিঅ্যাল তৈরি করব আমি নিজে।
হেলেনা হাই তুলল। ফখরুদিন সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তোমার ঘুম পাচ্ছে নাকি?
না।
শুধু ব্যবসা নিয়ে কথা বলছি বলে কী বিরক্তি লাগছে?
না।
টাকা খুব ইম্পর্ট্যিান্ট জিনিস, বুঝলে হেলেনা। যে-সোসাইটির দিকে আমরা যাচ্ছি, সেই সোসাইটির ঈশ্বর হচ্ছে টাকা। একটা সময আসবে, যখন তুমি টাকা দিয়ে সব কিনতে পারবে। সুখ, শান্তি, ভালবাসা সব।
হেলেনা দ্বিতীয বার হাই তুলল। ফখরুদিন সেই হাই সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলেন, খুব বেশি দূব তোমাকে যেতে হবে না। আজকের কথাই ধর। তোমার যদি প্রচুর টাকা থাকে, তাহলে তুমি সেই টাকাব্য বেহেশতে নিজের জন্যে একটা জায়গার ব্যবস্থা করতে পার।
কীভাবে?
টাকা খরচ করে হাসপাতাল দেবে, স্কুল-কলেজ দেবে, এতিমখানা বানাবে, লিঙ্গরখানা বসাবে। এতে পুণ্য হবে। সেই পুণ্যোব বলে বেহেশত। কাজেই টাকা দিযে তুমি পরকালের জন্যে ব্যবস্থা কবে ফেললে, যে-ব্যবস্থা। একজন ভিখিরি করতে পাববে না। ইহকালে সে ভিক্ষা করেছে, পরকালেও সে নিবকে পচবে কারণ তার টাকা নেই। হা হা হা।
তাঁর হাসি আর থামেই না। মাঝে-মাঝে একটু কমে, তার পরই আবার উদ্দাম গতিতে শুরু হয। হেলেনা ভয় পেযে উঠে দাঁড়াল। বন্ধ দরজার পাশে বাড়ির মেয়েরা এসে দাঁড়িযেছে। তাদের একজন দাবজান্য ধাক্কা দিলে বলল, কী হয়েছে?
ফখরুদিন সাহেব হাসতে-হাসতেই বললেন, নাথিং। এ্যাবসলুটলি নাথিং। পানি খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। ব্ৰিং মি সাম ওযাটার।