লতিফার চোখে বিস্ময়। এত বিশাল বাড়ি সে কল্পনাও করেনি। যা দেখছে তাতে মুগ্ধ হচ্ছে। এক সময় চাপা গলায় বলল, এদের বসার ঘরটা কত সুন্দর দেখেছেন?
সুন্দর লাগছে তোমার কাছে?
খুবই সুন্দর! ইস, আমাদের যদি এ রকম একটা বসার ঘর থাকত, তাহলে আমি আর কিচ্ছু চাইতাম না।
এই বসার ঘরটা আমার তৈরি করে দেয়া। ডিজাইন, ডেকোরেশন সব আমার।
সত্যি।
হ্যাঁ, সত্যি। তুমি চাইলে এর চেয়ে সুন্দর একটা ঘর আমি তোমার জন্যে বানিয়ে দেব।
আমি চাই। আমি একশ বার চাই। ঐ ছবিটাও তোমার আকা?
এই প্রথম লতিফা তুমি বলল। সে নিজেও তা বুঝতে পারল না। তার মুগ্ধ দৃষ্টি ছবিটির দিকে।
ছবিটা ভাল লাগছে?
হুঁ।
কেন ভাল লাগছে?
তা তো জানি না।
ফিরোজ মৃদু স্বরে বলল, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এইটা। অনেক সময় আমাদের অনেক কিছু ভাল লাগে, কিন্তু কেন ভাল লাগে তা আমরা বুঝতে পারি না। বুঝতে চেষ্টাও করি না।
সব কিছু বুঝে ফেলাও ভাল না।
ফিরোজ মনে-মনে হাসল। এই মেয়েটি দার্শনিক টাইপ নাকি? কত সহজে কঠিন কঠিন কথা বলেছে।
কাজের মেয়েটি ট্রেতে করে চা এবং নানান ধরনের খাবার-দাবার নিয়ে এসেছে। সে চায়ের কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে মৃদু স্বরে বলল, আপার শরীরটা ভাল না। আপা আজকে একতলায় নামবে না। আপনেরা আরেক দিন আসেন। ফিরোজের মুখ ছাইবৰ্ণ হয়ে গেল। লতিফা বলল, আমি উপরে গিয়ে ওনাকে দেখে আসি?
কাজের মেয়েটি বলল, জি না। বাইরের মানুষের উপরে উঠা নিষেধ আছে। লতিফা চ্যায়ের কাঁপে চিনি ঢেলে হালকা গলায় বলল, মিষ্টি হয়েছে কী না দেখা। ফিরোজ কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে, যেন এই মুহূর্তে রেগেমেগে একটা কাণ্ড করবে। লতিফা মৃদু স্বরে বলল, চা না খেয়ে যাওয়াটা আরো খারাপ হবে। চা খাও, কিছুক্ষণ বস। কাপগুলো কী সুন্দর, দেখেছি? তুমি আমাকে এ রকম এক সেট কাপ কিনে দিও।
ফিরোজ চুপ করে আছে। লতিফা শাড়ির আঁচলে গা ভাল মত জড়াতে-জড়াতে বলল, আজি বেশ শীত পড়েছে। তোমার শীত লাগছে না?
এ প্রশ্নেরও কোনো জবাব পাওয়া গেল না। ফিরোজ রিকশায় বসে আছে পাথরের মতো, তাকিয়ে আছে। শূন্যদৃষ্টিতে। তার কিছুই ভাল লাগছে না। লতিফা চাপা গলায় বলল, তোমাকে একটা কথা বলি? তুমি শুধু নিজের কথাটাই দেখছি। নিশ্চয়ই ওনার কোনো সমস্যা হয়েছে। কেউ কি আর ইচ্ছা করে কাউকে অপমান করে?
চুপ করে থাক। তুমি বেশি বক-বক কর।
সবার সঙ্গে করি না। কোনোদিন করবও না। শুধু তোমার সঙ্গে করব, রাগ কর আর যাই কর।
লতিফা তার হাত রাখল ফিরোজের হাতে। সেই হাত কেঁপে কেঁপে উঠছে। ফিরোজ বিস্মিত হয়ে বলল, কি হয়েছে লতিফা?
কিছু হয়নি।
কাঁদছ নাকি?
হ্যাঁ, কাঁদছি। তুমি এত লজ্জা পেয়েছ, তাই দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
ফিরোজের বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ তো বড় অদ্ভুত মেয়ে! সত্যি সত্যি কাঁদছে। ফিরোজ বিব্রত স্বরে বলল, কী শুরু করলে তুমি, কান্না থামাও তো!
লতিফা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, চেষ্টা করছি, পারছি না।
অপালা নিচে নেমে এল
ওরা চলে যাবার পরপরই খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অপালা নিচে নেমে এল। তাকে দেখে মনে হল, সে দীর্ঘ সময় নিয়ে সাজগোজ করেছে। গায়ে হালকা লাল রঙের শাড়ি। গলায় গাঢ় লাল রঙের রুবি-বসানো হার। কানের দুলের পাথর অবশ্যি রুবি নয়। স্বচ্ছ টোপাজ। লাল শাড়ির প্রতিফলনে সেগুলোও লালচে দেখাচ্ছে। অপালাকে দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি কোথাও বেরুবে।
বারান্দায় গোমেজ দাঁড়িয়ে ছিল। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অপালা লাজুক গলায় বলল, আমাকে কেমন লাগছে?
খুব সুন্দর লাগছে আপা।
বাবা কোথায়?
বাগানে বসে আছেন।
আমাদের দুকাপ চা দাও।
অপালা হালকা গায়ে বাগানে নেমে গেল। বাগান অন্ধকার। বারান্দার বাতি নেভানো বলে সব কিছুই কেমন অস্পষ্ট লাগছে। ফখরুদিন সাহেব অরুণা এবং বরুণাকে দুপাশে নিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। তার হাতে জুলন্ত চুরুট। অন্ধকারে চুরুটের আগুন ওঠানামা করছে। অপালা তার সামনে এসে দাঁড়াল।
অন্ধকারে বাগানে বসে আছ কেন বাবা?
এমনি বসে আছি, কিছু করার নেই।
তোমার শীত লাগছে না?
কিছুটা লাগছে।
এস ঘরে এস। এই ঠাণ্ডায় তোমার পাশে বসতে পারব না।
অপালার গলা সতেজ। কথায় ফুর্তির একটা ভঙ্গি, যা তার স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই মিশছে। না। সে বড় একটা সাদা চন্দ্রমল্লিকা ছিঁড়ে খোপায় পরল।
বসে রইলে কেন বাবা, এস।
অপালা ফখরুদ্দিন সাহেবের হাত ধরল। তিনি বিস্মিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
তোকে খুব খুশি-খুশি মনে হচ্ছে।
সবাই মুখ গোমড়া করে রাখলে চলবে? তোমার কারখানার ঝামেলা মিটেছে?
প্ৰায় মিটেছে। কিছু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। আরো টাকা খরচ হবে, এই আর কি।
ধনী হবার কত সুবিধা, তাই না বাবা? সব সমস্যা চট করে মিটিয়ে ফেলা যায়।
গরিব হবারও সুবিধা আছে। গরিবদের এ ধরনের কোনো সমস্যা থাকে না।
অপালা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে হালকা গলায় বলল, তা ঠিক, গরিবদের একমাত্র সমস্যা কীভাবে বেঁচে থাকবে। এই বেঁচে থাকার জন্যে কত কাণ্ড এরা করে! নিজের ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত বিক্রি করে দেয়।
ফখরুদ্দিন সাহেব হাতের চুরুট ছুড়ে ফেললেন। তাকালেন মেয়ের দিকে। অন্ধকারে অপালার মুখের ভাব দেখতে পেলেন না। শুধু মনে হল, মেয়েটির গলার স্বর হঠাৎ করে যেন খানিকটা বিষগ্ন হয়ে গেছে এবং মেয়েটি নিজেও তা বুঝতে পেরে প্রাণপণ চেষ্টা করছে বিষণুতা ঝেড়ে ফেলতে।