প্লিজ কাম ইন। কী ব্যাপার?
আপনি স্যার আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন।
আমি? কেন?
তাহলে বোধহয় স্যার আমার ভুল হয়েছে। আই অ্যাম সরি স্যার।
আপনি কে?
মেয়েটি অত্যন্ত অবাক হয়ে বলল, স্যার, আমার নাম রেখা। সুলতানা বেগম।
ও আচ্ছা আচ্ছা, আমি কনফিউজ করে ফেলেছি। বস, তুমি বস। চেয়ারটায় বস।
মেয়েটি আড়ষ্ট হয়ে বসল। ফখরুদিন সাহেবের অস্বস্থির সীমা রইল না। তিনি অফিসের কোনো মহিলা কর্মচারীকে তুমি বলেন না। একে কেন বললেন? মেয়েটি বসে আছে চুপচাপ। তাকাচ্ছে ভয়ে-ভয়ে। এই মেয়েটি অফিসে রোজ দেরি করে আসছে। তাকে কিছু শক্ত কথা বলা দরকার, কিন্তু তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন, কোনো শক্ত কথা তার মনে আসছে না। কী কারণ থাকতে পারে?
সুলতানা বেগম।
জি স্যার।
আমি ভুলে আপনাকে তুমি বলেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না।
ছিঃ ছিঃ স্যার, এটা আপনি কী বলছেন! আমি আপনার মেয়ের বয়সী।
মেয়ের বয়সী কথাটা উঠছে কেন? আমার কোনো মেয়ে নেই।
বলেই ফখরুদিন সাহেব চমকে উঠলেন। এটা তিনি কী বললেন। অনুশোচনায় তার মন ভরে গেল।
সুলতানা বেগম, আপনি এখন যান।
আপনার কী স্যার শরীর খারাপ?
আমার শরীর ভালই আছে।
যাব স্যার?
ফখরুদিন সাহেব উত্তর দিলেন না।
স্লামালিকুম স্যার।
মেয়েটি চলে যাবার পর তিনি বুঝতে পারলেন, কী কারণে একে তিনি কোনো কড়া কথা বলতে পারেননি। এই মেয়েটি তাকে হেলেনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। হেলেনার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই, কিন্তু মনে হল। সম্ভবত ঘোমটার কারণে; হেলেনার ঘোমটা দেয়ার বাতিক ছিল। তিনি কত বার বলেছেন, সব সময় ঘোমটা কেন? হেলেনা হেসে বলেছে, ভাল লাগে, বউ-বউ মনে হয়।
বউ সাজার এই সখী বিয়ের ত্ৰিশ বছরেও কাটল না।
অফিসের সবাই লক্ষ্য করল, তিনটা বেজে গেছে, তবু বড়সাহেব ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। সাড়ে তিনটার সময় ফখরুদিন সাহেবের বেয়ারা ইদ্রিস এসে বলল, সুলতানা। আপাকে স্যার আরেক বার একটু ডেকেছেন।
সুলতানা ছিল না। তার আজ এক জায়গায় জন্মদিনের দাওয়াত–সে তার স্বভাবমত কাউকে কিছু না বলে আগে-আগেই চলে গেছে।
অপালার হাতে ক্যাডবেরি চকলেটের দু’টি চৌকো টিন।
সে বেশ কিছু সময় হল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কড়া নাড়তে কেন জানি ভয় লাগছে।
ইচ্ছে করছে ফিরে চলে যেতে। দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে হঠাৎ অপালার কান্না পেয়ে গেল। সে বহু
কষ্টে কান্না থামিয়ে কড়া নাড়ল। মিষ্টি গলায় ভেতর থেকে বলল, কে?
অপালা জবাব দিল না। তার খুব ইচ্ছে করতে লাগল বলে, আমি তোমাদের একজন বোন। তোমরা আমাকে বাইরে ফেলে দিয়েছ।
কে কে?
অপালা ধরা-গলায় বলল, আমি।
দরজা খুলে গেল। আজ বাড়িতে মেয়েরাই শুধু আছে, অন্য কেউ নেই। পাঁচটি পরীর মতো মেয়ে আগের মতোই অবাক বিস্ময়ে তাকে দেখছে। অপালা চকলেটের বাক্স দু’টি এগিয়ে ধরল। কেউ হাত বাড়াল না।
সোমা শেষপর্যন্ত এগিয়ে এসে নিল। অপালা বলল, এদের নাম কী?
সোমা নিচু গলায় বলছে, কিন্তু কিছু অপালার মাথায় ঢুকছে না। তার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। এর আগে দু’দিন এমন কষ্ট হয়নি। আজ কেন হচ্ছে?
সোমা বলল, তুমি বসবে না?
না, বসব না। আমি চলে যাব।
একটু বাস। বাবা মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছে, আসতে অনেক দেরি। একটু বস।
অপালা বলল, ছোটরা জানে, আমি কে?
হ্যাঁ, জানে। কেন জানবে না? কত কথা আমরা বলি তোমাকে নিয়ে!
মেজো মেয়ে, যার নাম বিনু, সে হঠাৎ বলে উঠল, আপনি যখন হলিক্রস স্কুলে পড়তেন, তখন কত দিন আমরা আপনাকে দেখার জন্যে ফার্মগেট দাঁড়িয়ে থেকেছি!
তাই বুঝি?
জি। এক’দিন আপনি গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে একটা রিকশার নিচে পড়ে গেলেন। আপনার সেটা মনে আছে?
হ্যাঁ-হ্যাঁ আছে, মনে আছে। খুব ব্যথা পেয়েছিলাম। সেদিন স্কুলে যাই নি।
হ্যাঁ, আপনি চলে গিয়েছিলেন। তখন কী হয়েছিল জানেন? আব্বার ঐ রিকশাওয়ালার ওপর খুব রাগ হয়ে গেল। তখন আব্বা হঠাৎ ছুটে গিয়ে রিকশাওয়ালাকে একটা চড় মারলেন। তখন সব রিকশাওয়ালা আব্বাকে মারতে লাগল। কী যে অবস্থা! আমরা কাঁদতে-কাঁদতে বাসায় এসেছি।
তুমি আমাকে আপনি করে বলছে কেন?
বিনু মাথা নিচু করে অল্প হাসল। সোমা বলল, বিনু ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়েছে।
তাই নাকি?
ও আবার কবি। কবিতা লেখে। বিনু, তোর কবিতার খাতাটা আন না।
বিনু সঙ্গে-সঙ্গে খাতা নিয়ে এল। অপালার হাতে খাতা দিতেই অপালার চোখ দিয়ে টপ-টপ করে জল পড়তে লাগল।
সোমা এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। একটা হাত রেখেছে অপালার কাধে। অন্য বোনরা তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে অপালাকে। শুধু বিনু ফ্রকের আঁচলে চোখ চাপা দিয়েছে। সোমা বলল, তোমরা সবাই যাও তো, অপালার জন্যে চা বানাও।
মুহূর্তে ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। সোমা বলল, আমাদের ওপর তোমার খুব রাগ, তাই না?
না। রাগ করব কেন?
জানো অপালা, তোমার ঘটনাটা জানার পর থেকে আমি বাবার সঙ্গে কথা বলি না। আজ চৌদ বছর। আমি একটি কথাও বলি না। তোমার বিশ্বাস হয়? বাবা এই জন্যে ঘরেও বিশেষ থাকে না।
তার হয়তো উপায় ছিল না। যা করেছেন, বাধ্য হয়ে করেছেন।
অপালা খুব কাঁদছে। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না। সোমা তার পাশেই বসে আছে মূর্তির মতো। তার চোখ শুকনো। ছোটবেলা থেকেই সে কাঁদতে পারে না। কত দুঃখ-কষ্ট বয়ে গেছে জীবনের ওপর দিয়ে, অথচ তার চোখে জল আসেনি। আজ তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু কান্না আসছে না।