এখন তিনি যেখানে আছেন, সেটা একটা বড় হলঘরের মতো। সাত জন কর্মচারী পাশাপাশি টেবিলে কাজ করেন। সবাই এসে গেছে, শুধু ওয়ার্ড প্রসেসরের মেয়েটি আসেনি। এই মেয়েটিকে চার মাস আগে চাকরি দেয়া হয়েছে। তাকে প্ৰায়-সময়ই তিনি দেখেন না। এই মেয়েটির বয়স অল্প, একে ধমক দিতে তার মায়া লাগে। আজ তাকে কিছু বলবেন।
মুনিম সাহেব।
জি স্যার।
ঐ মেয়েটি আসেনি?
এসে পড়বে স্যার।
এসে পড়বে, সেটা কী করে বললেন? না-ও তো আসতে পারে। আজ হয়ত সে কোনো কারণে বাড়িতে ছুটি কাটাবে।
মুনিম সাহেব চুপ করে রইলেন। ফখরুদিন সাহেব বললেন, বসুন, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
মনে পড়ছে না। ওর কী নাম?
রেখা।
রেখা নিশ্চয়ই ডাকনাম। ভাল নাম কী?
সুলতানা। সুলতানা বেগম।
সুলতানা বেগমকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন।
জি আচ্ছা স্যার।
তিনি নিজের ঘরে ঢুকলেন। তার খাস বেয়ারা তৎক্ষণাৎ গরম এক কাপ চা তার টেবিলে এনে রাখল।
ইদ্রিস, কী খবর তোমার?
জি স্যার, ভাল।
নিশানাথবাবুকে খবর দাও।
ফখরুদ্দিন সাহেব চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে প্যাড টেনে নিলেন। আজ দুপুর একটা পর্যন্ত কী-কী কাজ করবেন, সেগুলো লিখে ফেলবেন। একেকটা কাজ শেষ হবে, তিনি লাল কালিতে সেটা কাটবেন। একটা বাজার আগেই সব কাটা হয়ে যাবে। আলাদা একটি ফাইলে সেই কাগজ তুলে। এই ফাইলটি ব্যক্তিগত। সবসময় নিজের কাছে রাখেন। আজ তিনি যা-যা লিখলেন তা হচ্ছে :
১. পুলিশ তদন্ত; কত দূর কী হল?
২. চিটাগাং ব্রাঞ্চ অফিস : কেন পেপার মিল বন্ধ?
৩. ইউনিয়ন কর্মকর্তা জলিল : শায়েস্তা করতে হবে।
৪. মোস্তাক মিয়া : সে কী চায়?
৫. সুলতানা বেগম : কেন সে রোজ দেরি করে আসে?
৬. টেলিফোন : হেলেনা কেমন আছে?
ফখরুদিন সাহেব লেখা অক্ষরগুলোর দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইলেন। পাঁচ নম্বর পয়েন্টটি কেটে দিলেন। অতি ক্ষুদ্র ব্যাপারে তাঁর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।
স্যার, আসব?
আসুন নিশানাথবাবু। কেমন আছেন?
জি স্যার, ভাল। কী জন্যে ডেকেছেন?
আপনি আমার আশপাশেই থাকবেন। দরকার হলেই যেন পাই।
তা তো স্যার থাকি।
পুলিশ ইনকোয়ারি কোন পর্যায়ে আছে এটা আপ-টু-ডেট জানতে চাই।
জি আচ্ছা স্যার।
মোস্তাক মিয়া নামে এক লোককে আজ আমি সাড়ে এগারটায় আসতে বলেছি। সে এলে তাকে দক্ষিণের ঘরটায় বসাবেন।
সে স্যার এসে গেছে।
বেশ, ঐ ঘরে নিয়ে বসান। চা দিন। তার সঙ্গে কোনো গল্পগুজব করার প্রয়োজন নেই।
জি না স্যার। গল্পগুজব কেন করব?
ঠিক আছে, যান। পি.এ.-কে বলুন লন্ডনের সেন্ট লিউক হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমি হেলেনার ব্যাপারে খোঁজ নেব। পি.এ.-র কাছে টেলিফোন নাম্বারা আছে।
নিশানাথবাবু ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ামাত্র তিনি চার নাম্বার পয়েন্টটি কেটে দিলেন। ঘড়ি দেখলেন। সাড়ে এগারোটা বাজতে এখনো অনেক দেরি। তিনি মোস্তাককে সাড়ে এগারটায় আসতে বলেছেন: তিনি ততক্ষণ অপেক্ষা করবেন।
দক্ষিণের যে ঘরটিতে মোস্তাক মিয়া বসে ছিল, সেটা একটা মিনি কনফারেন্স রুম। অল্প কিছু লোকজনের সঙ্গে বিশেষ কোনো গোপনীয় আলাপের প্রয়োজন হলে ঘরটি ব্যবহার করা হয়। একটিমাত্র দরজা–এটা বন্ধ করা মাত্র বাইরে লাল আলো জ্বলে।
ফখরুদ্দিন সাহেব ঠিক সাড়ে এগারটায় সেই ঘরে ঢুকলেন। নিজেই হাত দিয়ে টেনে দরজা বন্ধ করলেন।
দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাস।
তিনি সিগারেট কেস থেকে সিগারেট বের করে নিজে ধরালেন, একটি বাড়িয়ে দিলেন।
নাও, সিগারেট নাও। নাও, নাও।
তিনি নিজেই মোস্তাকের সিগারেট ধরিয়ে দিলেন।
তুমি ভাল আছ?
জি স্যার।
তিনি লক্ষ্য করলেন, লোকটির সামনে চায়ের কাপ। চা ঠাণ্ডা হয়ে হালকা সর পড়েছে। সে চায়ে মুখ দেয়নি। ফখরুদিন সাহেব ঠিক তার সামনের চেয়ারটিতে বসলেন। সহজ স্বরে বললেন, তুমি আমার কাছে কী চাও?
স্যার, আমি তো কিছু চাই না।
না-চাইলে কেন তুমি আমার বাসায় এসেছিলে? কেন আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছ?
আমি বড় মেয়েটার বিয়ে দিচ্ছি, দাওয়াতের কার্ড নিয়ে…
দাওয়াত দিতে গিয়েছিলে?
আমার মেয়েগুলো খুব সরল। বড় মেয়েটা কান্নাকাটি করছিল।
শোন মোস্তাক মিয়া, তুমি এক সময় না খেয়ে মরতে বসেছিলে। আমি তোমাকে সাহায্য করেছিলাম, যে-কারণে আজ তুমি ফর্সা জামাকাপড় গায়ে দিচ্ছি, মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে কার্ড ছাপানোর পয়সাও তোমার হয়েছে।
আপনি আমাকে সাহায্য করেননি। স্যার।
তার মানে? পনের হাজার টাকা নগদ তোমার হাতে দিয়েছি। তোমাকে একটা দোকান করে দিয়েছি।
কথা বলতেও শিখেছি মনে হচ্ছে।
ফখরুদিন সাহেব আরেকটি সিগাটে ধারালেন। তার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। বমি-বমি ভাব হচ্ছে। তিনি তাকিয়ে আছেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।
আমার মেয়ে গিয়েছে তোমার ওখানে?
জি।
দুবার গিয়েছে, তাই না?
আমার সঙ্গে দেখা হয়নি।
তোমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তোমার মেয়েদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তোমাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার কারণে সে নিদারুণ মানসিক কষ্টে আছে। মেয়েটাকে কেন কষ্ট দিলে?
ইচ্ছা করে দিইনি স্যার।
আমার মেয়েকে দেখে তোমার স্ত্রী, তোমার কন্যারা কী খুশি হয়েছে? আমাকে বল, কেমন আনন্দ-উল্লাস হল।
মোস্তাক মিয়া চুপ করে রইল। ফখরুদিন সাহেব বললেন, চুপ করে আছ কেন, বল? তোমার স্ত্রী কেমন খুশি?
ওর বোধশক্তি নেই স্যার মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে। কিছু বুঝতে পারে না। মেয়েটা যাওয়ার পর থেকে এই অবস্থা স্যার।