অপালা তার গায়ের নীল চাদর তার বাবার গায়ে জড়িয়ে দিল।
তুমি রাতে কী খাবে, বাবা?
কোন?
আমি রান্না করব।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
ফখরুদ্দিন সাহেব। আবার বাগানে গিয়ে বসলেন। অরুণা এবং বরুণা দু’জন দুপাশ থেকে এসে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর আনন্দে ফখরুদিন সাহেবের চোখ ভিজে উঠছে। চোখের জল মানেই দুর্বলতা। তার মধ্যে কোনোরকম দুর্বলতা থাকা উচিত নয়। এই অশ্রুবিন্দু এক্ষুণি মুছে ফেলা উচিত। কিন্তু তিনি মুছলেন না। চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। এই অন্ধকারে তাঁর দুর্বলতা কেউ দেখে ফেলবে না।
অপালা আসছে চা নিয়ে। বারান্দার আলো তার মুখে পড়েছে। কী সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।
এখন দুপুর
এখন দুপুর।
গরমের দুপুরে চারদিক ঝিম ধরে থাকে। ভূতে মারে ঢ়িল। কিন্তু শীতের দুপুরগুলো অন্য রকম। সকাল-সকাল একটা ভাব লেগে থাকে। রোদে পিঠ মেলে খবরের কাগজ হাতে বসে
থাকতে চমৎকার লাগে।
ফিরোজ বেশিক্ষণ রোদে বসে থাকতে পারল না। ছায়া এসে পড়ল। তার ঘুম-ঘুম পাচ্ছে। সমস্ত শরীর জুড়ে আরামদায়ক আলস্য। ফিরোজ লেপের ভেতর ঢুকে পড়ল। জানালার রোদ পড়ে লেপ ওম হয়ে আছে। কুসুম-কুসুম গরমে কী চমৎকারই না লাগছে! হাসপাতাল থেকে সে ছাড়া পেয়েছে গত পরশু। শরীর এখনো পুরোপুরি সারেনি। আরামদায়ক একটা ক্লান্তি সারাক্ষণ তাকে ছয়ে থাকে। সে ঘুমিয়ে পড়ল। সুন্দর একটা স্বপ্নও দেখে ফেলল।
যেন অপালা তার ঘরে এসেছে। অনেকক্ষণ ধরে দরজার কড়া নাড়ছে। কিন্তু তার ঘুম ভাঙছে না। অপালা বার-বার বলছে–প্লিজ উঠিন, প্লিজ উঠুন। এমন অসময়ে কেউ ঘুমায়? সে সব শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু তার ঘুম ভাঙছে না।
একসময় সত্যি সত্যি সে জেগে উঠল। অবাক হয়ে দেখল। ঘরের ভেতর শাড়িপর একজন কে যেন হাঁটছে। না, অপালা নয়, বড় আপা। ফিরোজের মনে হল, যা দেখছে তাও সত্যি নয়। স্বপ্নেরই কোনো অংশ। একমাত্র স্বপ্নের মধ্যেই একজন মানুষ চট করে অন্য একজন হয়ে যায়। সেই পরিবর্তনটাকেও মনে হয় খুব স্বাভাবিক।
তাজিন বলল, এই ওঠা। আর কত ঘুমুবি? সন্ধ্যা বানিয়ে ফেললি তো!
ফিরোজ ধড়মড় করে উঠল। এটা মোটেই স্বপ্ন নয়। ঐ তো বড় আপা।
কখন এসেছিস?
অনেকক্ষণ। কত রকম শব্দটব্দ করছি। তোর ঘুম আর ভাঙেই না। এক বার চোখ মেলে খানিকক্ষণ দেখিস, তারপর আবার ঘুম। তোর শরীর এত খারাপ?
কিছুটা তো খারাপই। তোকে নিতে এসেছি।
কোথায়?
কোথায় আবার, আমার বাসায়। একা আসিনি। দলবল নিয়ে এসেছি।
দলবল তো দেখছি না।
দেখিবি কী করে, ওরা হাজি সাহেবের বাড়িতে মচ্ছবে লেগে গেছে।
মাচাছবে লেগে গেছে মানে?
তোর বিয়ে নিয়ে ফাইন্যাল কথাবার্তা হচ্ছে।
ফিরোজ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। কী বলবে ভেবে পেল না। তাজিন বলল, শোকে পাথর হয়ে গেলি মনে হচ্ছে! এ রকম করে তাকাচ্ছিস কেন?
কথাবার্তা বলছে কে দুলাভাই?
দুলাভাই কথাবার্তা বলার লোক? বড় মামা এসেছেন, ফুপা এসেছেন।
কী সৰ্বনাশ!
কাপড় পর। চল নিচে যাই।
আমি নিচে যাব কেন?
আমি বলছি, এই জন্যে নিচে যাবি। সারা জীবন তুই চললি নিজের মত। কারো কথা শুনলি না। বয়স তো তোর কম হল না। এখনো যদি লাইফের একটা পারপাস না পাওয়া যায়..।
বক্তৃতার দরকার নেই।
নে, তোর জন্যে একটা পাঞ্জাবি এনেছি, এটা গায়ে দে।
পাঞ্জাবি গায়ে দেব কেন?
কী-রকম বোকার মতো কথা! তুই কী পাঞ্জাবি কখনো গায়ে দিস না? সারা জীবন তো গায়ে আধময়লা পাঞ্জাবিই দেখলাম।
ফিরোজ পাঞ্জাবি গায়ে দিতে-দিতে বলল, এখানে আসার ব্যাপারটা কী আগে থেকেই এ্যারেঞ্জ করা ছিল, না হঠাৎ ঠিক হয়েছে?
খবর দেয়া ছিল। তোকে কোনো খবর দেয়া হয়নি। কারণ, আমাদের সবার ভয়, বিয়ের কথায় তুই পালিয়ে যেতে পারিস। আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইনি। তোর ওপর নজর রাখার জন্যে লোক ছিল।
তাজিন তরল গলায় হাসল।
মন্টু সকাল থেকে তোর সঙ্গে ছিল না?
হ্যাঁ, ছিল।
তার দায়িত্ব ছিল তোকে আটকে রাখা। নে, পায়জামাটা পর। ভাল করে চুল আঁচড়া।
আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।
নিচে নামলেই বুঝতে পারবি। এজিন কাবিন হবে। রুসমত সামনের মাসের সতের তারিখ।
ফিরোজ চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে রইল।
এ রকম করে তোকাচ্ছিস কেন? তুই নিজে আমাকে বলেছিস, মেয়েটিকে তোর খুব পছন্দ। আমাদের ওপর রাগটোগ যা করবার, পরে করবি। এখন নিচে নেমে আয়। সবাই অপেক্ষা করছে।
ফিরোজ বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ছসাতটা গাড়ি হাজি সাহেবের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খোলা মাঠে সুন্দর সুন্দর পোশাক পরা একগাদা ছেলে।পুলে ছোটাছুটি করে খেলছে। ফিরোজকে দেখতে পেয়েই তাজিনের সবগুলো মেয়ে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল–মামার বিয়ে, মামার বিয়ে।
সূৰ্য প্রায় ডুবে যাচ্ছে। চারদিকে তার অপরূপ সোনালি আলোর শেষ ছটা। এই আলোয় এমনিতেই সবার মন কেমন করে। ফিরোজের হৃদয় বিষাদে পূর্ণ হল যদিও এই মেয়েটিকে সে সত্যি-সত্যি কামনা করে। সে নিশ্চিত, এই মেয়েটি তার জীবনে কল্যাণময়ীর ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে, তাকে সারা জীবন ডুবিয়ে রাখবে গভীর ভালবাসায়।
ফখরুদিন সাহেব অফিসে এলেন ঠিক দশটায়।
তিনি অফিসে পা দেয়ামাত্র বড় দেয়াল-ঘড়িতে ঘণ্টা বাজতে শুরু করল। তিনি নিজের ঘর না
ঢুকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কটা ঘণ্টা শুনলেন। এই অভ্যেস তার দীর্ঘকালের। এর পেছনে তার
উদ্দেশ্যও খুব পরিষ্কার। অফিসের সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চান যে, ঘড়ির কাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি চলেন, এবং আশা করেন অন্যরাও তাই করবে।