ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। তাঁর ঠোঁটে সূক্ষ্ম একটা হাসির রেখা। ফিরোজ বাইরে এসে দেখল সমস্ত বারান্দা আলো করে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। এত সুন্দর হয় মানুষ!
এই মেয়ে, তুমি একা একা দাঁড়িয়ে আছ কেন? এস, ভেতরে এস।
সে সঙ্গে-সঙ্গে রওনা হল। তার গায়ে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি। মাথায় ঘোমটা দেয়ার জন্যে কেমন বউ-বউ লাগছে।
বোরকা কোথায় তোমার?
মেয়েটিও তার মায়ের মতো ভঙ্গিতে হাসল।
এস, বস।
বেডের সামনে একটা খালি চেয়ার। সে সেখানে বসল না। বিছানায় মাথা নিচু করে বসে রইল।
তুমি কী আমাকে দেখতে এসেছি, না। আরেকজন যে রুগী আছে, তাকে দেখতে এসেছ?
মেয়েটি বিস্মিত গলায় বলল, আর তো কোনো রুগী নেই!
ফিরোজ কী বলবে ভেবে পেল না। কিছু একটা বলতে ইচ্ছে করছে। বড় মায়া লাগছে মেয়েটির জন্য।
তুমি চা খাবে?
জি না।
খাও-না এক কাপ। তোমার সঙ্গে আমিও খাব। এখানে একটা বয় আছে, ওকে বললেই নিচ থেকে চা এনে দেয়।
বলুন!
ফিরোজ চায়ের কথা বলে এল। মেয়েটি কৌতূহলী হয়ে রুগীদের দিকে দেখছে।
হাসপাতাল নিশ্চয়ই তোমার খুব খারাপ লাগে, তাই না?
জি না। অনেক দিন আমি হাসপাতালে ছিলাম, হাসপাতাল আমার ভালই লাগে। আপনার অসুখ এখন সেরে গেছে, তাই না?
হ্যাঁ।
চা এসে গেল। মেয়েটি ছোট ছোট চুমুকে চা খাচ্ছে। বার-বার তাকাচ্ছে ফিরোজের দিকে। এখন আর সেই দৃষ্টিতে কোনো লজ্জা আর সঙ্কোচে নেই। ফিরোজ আন্তরিকভাবেই বলল, তুমি এসেছি, আমার খুব ভাল লাগছে।
মেয়েটি অত্যন্ত মৃদু স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলল, অপালা বলে যে-মেয়েটি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল, ওকে আপনি কীভাবে চেনেন?
হঠাৎ করে পরিচয়। ও আমাকে সুন্দর একটা চিঠি লিখেছে, তুমি কী ঐ চিঠিটা পড়বে?
জি না।
তুমি পড়, তুমি পড়লে আমার ভাল লাগবে।
ফিরোজ চিঠি বের করল। মেয়েটি তাকিয়ে আছে তার দিকে। কী সুন্দর স্বচ্ছ চোখ। শুধু চোখের দিকে তাকালেই যেন এই মেয়েটির অনেকখানিই দেখে ফেলা যায়।
বিকেল হয়ে আসছে। দিনের আলো কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। চেনা পৃথিবীও এই আলোতে অচেনা হয়ে যায়।
ফখরুদিন সাহেব বাগানে চেয়ার পেতে বসে আছেন। তাকে চা দেয়া হয়েছে। তিনি চা খাচ্ছেন না। তাঁর পায়ের কাছে অরুণা ও করুণা। তিনি বরুণার পিঠ মাঝে মাঝে চুলকে দিচ্ছেন। তাঁর কাছেই গোমেজ দাঁড়িয়ে। তাকে তিনিই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এখন কিছু বলছেন না। গোমেজ যেতে পারছে না, অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
গোমেজ।
জি স্যার।
কটো বাজে বল তো?
সাড়ে চারটা বাজে স্যার।
মাত্র সাড়ে চার, কিন্তু চারদিক এমন অন্ধকার হয়ে আসছে কেন? সূৰ্য কাঁটার সময় ডোবে?
ঠিক বলতে পারছি না। স্যার।
খবরের কাগজে দেখ তো ওখানে দেয়া আছি কী না। সানসেট এবং সানরাইজ যদি দেয়া না থাকে, তাহলে আবহাওয়া অফিসে টেলিফোন করবে।
জি আচ্ছা স্যার।
ঘট-ঘট শব্দ হচ্ছে কিসের?
বসার ঘরটা নতুন করে সাজানো হচ্ছে স্যার।
ওদের নিষেধ করতে বল। আমার মেয়ে পছন্দ করে সাজিয়েছে ওটা, যেমন আছে তেমন থাকুক।
জি আচ্ছা স্যার।
গোমেজ চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। মৃদু স্বরে বলল, আপাকে কী খুঁজেত বের হব?
না।
ফখরুদিন সাহেব অরুণার পিঠ চুলকে দিতে লাগলেন। বাগান এখন প্রায় অন্ধকার। তার শীত লাগছে, তবু তিনি বসেই আছেন। আকাশে একটি-দু’টি করে তারা ফুটতে শুরু করেছে। গোলাপ-ঝাড় থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি সৌরভ।
অপালা বাড়ি ফিরল সন্ধ্যা মেলানোর পর। সে ভেবেছিল, গেটের পাশে সবাই ভিড় করে থাকবে। তা নয়, গোট ফাঁকা। অন্য সময় তালা দেয়া থাকে, আজ তাও নেই। দারোয়ান টুলের ওপর বসে বসে ঝিমুচ্ছে। অপালাকে দেখে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু কিছু বলল না।
অপালা বারান্দায় উঠে এসে প্রথম লক্ষ্য করল বাগানে বেতের চেয়ারে কে যেন বসে আছে। বাগানের আলো জ্বলছে না। জায়গাটা অন্ধকার। সিগারেটের আগুন ওঠানামা করছে। অপালা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডাকল, বাবা!
ফখরুদিন সাহেব উত্তর দিলেন না। সিগারেট ছুড়ে ফেললেন। অপালা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বালিকার মতো শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল। ফখরুদিন সাহেবের একটা হাত মেয়ের পিঠে। তিনি গাঢ় স্বরে বার-বার বলছেন, মাই চাইন্ড। মাই চাইল্ড।
অপালা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, কখন এসেছ?
এই তো সকালে। তুমি সারা দিন কোথায় ছিলে?
নানান জায়গায় ছিলাম। তুমি কেমন আছ বাবা?
ভাল। আমি খুব ভাল আছি।
ঠাণ্ডার মধ্যে এখানে বসে আছ কেন?
তোমার জন্যে বসে আছি।
মা আসেনি, তাই না?
কী করে বুঝলে?
মা এলে সেও তোমার সঙ্গে বসে থাকত। তুমি এসেছি, বাবা, আমার খুব ভালো লাগছে।
অপালা আবার ফোঁপাতে শুরু করল।
মা এল না কেন?
ডাক্তাররা এখন বলছে, বাই পাস সার্জারি লাগবে।
একেক সময় এরা একেক কথা বলে কেন?
কি জানি, কেন!
বাবা এস, তোমাকে আমাদের বসার ঘরটা দেখাই, কী সুন্দর যে করেছে।
ফখরুদিন সাহেব এই ঘর আগেই দেখেছেন, তবু মেয়ের সঙ্গে ঢুকলেন।
কেমন লাগছে বাবা?
ভাল।
শুধু ভাল? এর বেশি কিছু না?
না মা, এর বেশি কিছু না। তবে তোমার ভাল লাগছে, এটাই বড় কথা। আমার পুরনো চোখ। পুরনো চোখ সহজে মুগ্ধ হয় না।
বাবা, তুমি চা খেয়েছ?
হ্যাঁ। তবে আরেক বার খেতে পারি।
তুমি বাগানে গিয়ে বস, আমি তোমার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।
তোমার বানাতে হবে না, তুমি আমার সঙ্গে এসে বস।
না, আমিই বানাব। আর শোন, একটা চাদর গায়ে দিয়ে যাও। নাও, আমারটা নাও।