কী জানতে চান আমার কাছ থেকে, বলুন?
একটা তারিখ আপনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাই। আসামি বলছে, সে আপনার নির্দেশে এই কাজ করেছে। কোন তারিখে সে আপনার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে, তাও সে বলেছে। আমরা দেখতে চাই, ঐ তারিখে আপনি দেশে ছিলেন কী না।
আমার কাছ থেকেই জানতে চান?
জি স্যার।
এটা একটা কাঁচা কাজ হচ্ছে না। কী? এয়ারপোর্টে কাগজপত্র দেখলেই তো তা জানতে পারেন। আমার মুখের কথার চেয়ে ঐ সব প্রমাণ নিশ্চয়ই অনেক মূল্যবান।
তাও স্যার করা হবে। আপনার একটা স্টেটমেন্ট নেব।
ভাল কথা, নেবেন। আপনার নাম কী?
রশিদ। আব্দুর রশিদ।
শুনুন রশিদ সাহেব, এই ধরনের কোনো কিছু আমার বলার ইচ্ছা যদি থাকে, তাহলে আমি কী তা সরাসরি বলব? অন্যদের দিয়ে বলাব। এমন একটা কাঁচা কাজ কী আমি করতে পারি?
মাঝে মাঝে খুব পাকা লোকও স্যার কাঁচা কাজ করে ফেলে।
হ্যাঁ, তা করে। কথাটা আপনি ভালই বলেছেন। ওয়েল সেইড।
পুলিশ অফিসার আধা ঘণ্টা সময় নিয়ে স্টেটমেন্ট নিলেন। তাকে চা-বিসকিট কিছু দেয়া হল না। ভদ্রলোক চলে যাবার পরপরই পি. আর. ও. আব্বাসার সাহেবকে ফখরুদিন সাহেব ডেকে পাঠালেন।
আবসার সাহেব।
জি স্যার।
পুলিশ অফিসার আব্দুর রশিদ সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। লোকটির টাকা নেয়ার অভ্যেস আছে কী না দেখুন। পুলিশ অফিসারদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ত্যাদড় ধরনের থাকে। টাকা পয়সা নেয় না। তবে আমার ধারণা, এ নেয়। এর গায়ের শালটি বেশ দামি। বেতনের টাকায় এ-রকম শাল কেনার কথা নয়।
আমি স্যার খোঁজ নেব।
আজি সন্ধ্যার মধ্যে নেবেন। ইনভেসটিগেশন টিমে আর কে-কে আছে দেখুন। ডি.আই.জি. রহমতউল্লাহ সাহেব এখন কোথায় আছেন, কোন সেকশনে, তাও দেখবেন।
জি স্যার।
আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি এই সমস্যার পুরো সমাধান চাই।
জি স্যার।
আপনি এখন যান।
অফিসে আসবেন স্যার?
হ্যাঁ। তিনটার দিকে যাব।
জি আচ্ছা স্যার।
দুপুরে ফখরুদিন সাহেব একা একা ভাত খেলেন। অপালা এখনো ফেরেনি। ভাত খেতে খেতে দারোয়ানের দিয়ে যাওয়া খাতাটি খুঁটিয়ে-খুটিয়ে পড়লেন। ফাঁকে-ফাকে গোমজের সঙ্গে রান্নাবান্না নিয়ে গল্প করলেন। এটি তাঁর পুরনো অভ্যেস।
গোমেজ।
জি স্যার।
পৃথিবীর সব দেশে রান্নায় পনির ব্যবহার করে, বাংলাদেশে কেন করে না?
আমি তো স্যার বলতে পারব না।
এমন তো নয় যে এ দেশে পনির তৈরি হত না। হাজার-হাজার বছর ধরে পনির তৈরি হচ্ছে। হচ্ছে না?
জি স্যার।
আমাদের দেশী রান্নায় খানিকটা পনির দিয়ে দিলে কেমন হবে বলে তোমার ধারণা?
আমি তো স্যার বলতে পারছি না।
এক বার দিয়ে দেখবে।
জি আচ্ছা স্যার।
তিনি বিশেষ কিছু খেতে পারলেন না। কিছুদিন ধরেই তার খিদের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
গোমেজ।
জি স্যার।
লাঞ্চের পর কাউকে তুমি মাটিনি খেতে দেখেছ?
জি স্যার, দেখেছি। মেক্সিকান এক সাহেবকে দেখেছি।
একটা মাটিনি তৈরি কর তো।
মাটিনি খেয়ে তাঁর শরীর আরো খারাপ লাগতে লাগল, তবু তিনি ঠিক তিনটায় অফিসে গেলেন। ডেকে পাঠালেন ঢাকা ব্ৰাঞ্চের এ. জি. এম. মোস্তফা সাহেবকে। অত্যন্ত ঠাণ্ডা, গলায় বললেন, মোস্তফা, আমার ধারণা যাবতীয় ঝামেলার পেছনে আপনি আছেন।
এইসব আপনি কী বলছেন স্যার!
আমি ঠিকই বলছি। ভুল বললে এত দূর আসতে পারতাম না, অনেক আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে যেতাম। আপনি আপনার চার্জ বুঝিয়ে দিন।
স্যার, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!
আপনি ঠিকই বুঝতে পারছেন।
ফখরুদিন সাহেব কোটের পকেট থেকে বরখাস্তের চিঠি বের করলেন। এই চিঠি তিনি ইংল্যান্ড থেকেই টাইপ করে নিয়ে এসেছেন।
চিঠি হাতে মোস্তফা দাঁড়িয়ে, তিনি তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পি.এ.-কে বললেন, বাসায় টেলিফোন করে দেখ তো আমার মেয়ে ফিরেছে কী না।
পি.এ. জানাল এখনো ফেরেনি। ফখরুদ্দিন সাহেবের কপালে সূক্ষ্ম একটা ভাজ পড়ল। সেই ভাজ স্থায়ী হল না। তিনি পি.এ.-কে বললেন, গাড়ি বের করতে বল, আমি কারখানা দেখতে যাব। ইউনিয়নের নেতাদেরও খবর দিতে বল–আমি ওদের সঙ্গে কথা বলব।
আপনার ওখানে এখন যাওয়াটা ঠিক হবে না। স্যার।
আমাকে উপদেশ দেয়া তোমার কাজের কোনো অঙ্গ নয় বলেই আমি জানি। তোমাকে যা করতে বলেছি, কর।
স্যার, এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি।
গুড। ভেরি গুড।
হাজি সাহেবের স্ত্রী ভিজিটার্স আওয়ারে ফিরোজকে দেখতে এসেছেন। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, ভদ্রমহিলার গায়ে বোরকা নেই। ফিরোজ তাকে আগে দেখেনি। সে অবাক হয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে চিনতে পারছি না।
ভদ্রমহিলা একগাদা ফলমূল নিয়ে এসেছেন। এর সঙ্গে আছে একটা হরলিকস, একটা ওভালটিন। তিনি বেশ সহজ ভঙ্গিতে বললেন, আমি হাজি সাহেবের স্ত্রী।
ও আচ্ছা। বসুন বসুন।
বেশিক্ষণ বসতে পারব না। হাসপাতালে ফিমেল ওয়ার্ডে আমাদের একজন রুগী আছে, তাকে দেখতে যাব। তোমাকেও চট করে দেখে গেলাম।
এইসব খাবারদাবার আমার জন্যে এনেছেন, না ওনার জন্যে?
ভদ্রমহিলা হেসে ফেললেন। ভদ্রমহিলার এই হাসি ফিরোজের পছন্দ হল। রসবোধ আছে। মেয়েদের এই জিনিসটা একটু কম। সাধারণ রসিকতাতেও এরা রেগে যায়।
আপনি আমাকে দেখতে আসবেন, এটা তো স্বপ্নেও ভাবিনি!
পুনু দেখতে আসব না? শুধু আমি একা না, আমার মেয়েও এসেছে।
সে-কী?
ভেতরে আসতে লজ্জা পাচ্ছে–বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। থাকুক দাঁড়িয়ে, আমি আমার রুগী দেখে আসি।