আশপাশে কোনো চায়ের দোকান নেই যে বসা যায়। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। সামান্য জ্বরে শরীর বড় বেশি কাবু হয়েছে। অসুখ-অসুখ একটা গন্ধ বেরুচ্ছে গা থেকে। পেটে আবার পাক খেতে শুরু করেছ। এবার নির্ঘাত বমি হবে। অপালা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখবে সে রাস্তায় উবু হয়ে বসে বমি করছে। সে বড় কুৎসিত দৃশ্য। এই দৃশ্য অপালাকে কিছুতেই দেখানো যায় না। ফিরোজ একটা রিকশায় উঠে পড়ল।
অপালা অনেকক্ষণ হল কড়া নেড়েছে। ভেতর থেকে মিষ্টি গলায় একটি মেয়ে বলল, কে?
অপালা কী বলবে ভেবে পেল না। সে যদি বলে–আমি অপালা। তাহলে কেউ কিছু বুঝবে না। শুধু আমি বলারও কোনো মানে নেই। সে আবার কড়া নাড়ল। ভেতর থেকে সেই মেয়েটি আবার বলল, কে? যেন জবাব না পেলে দরজা খুলবে না।
অপালা বলল, দরজাটা কী খোলা যাবে?
খুট করে দরজা খুলল, তাও পুরোপুরি নয়। অল্প একটু ফাক করে বার-তের বছরের মেয়েটি মুখ বের করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটিকেই অপালা তাদের গেটের বাইরের দেখেছে। মেয়েটি কী যে অবাক হয়েছে! চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলছে না। অপালাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ছুটে ভেতরে চলে গেল। তার পরপরই অনেকগুলো পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। বাড়ির সবাই যেন একসঙ্গে ছুটে আসছে। অপালার লজ্জা করতে লাগল।
এ-বাড়িতে বোধহয় কোনো ছেলে নেই। পাঁচটি বিভিন্ন বয়সের মেয়ে তাকে ঘিরে আছে। এদের সবার মুখের দিকে খানিকক্ষণ করে তাকাল। একটি শীতল স্রোত বয়ে গেল অপালার গা দিয়ে। এই মেয়েগুলো দেখতে তার মতো, বিশেষ করে বড় মেয়েটি। অপালা কাঁপা গলায় বলল, তোমরা কেমন আছ? কেউ কোনো জবাব দিল না। বাড়ির ভেতর থেকে একজন মহিলা বললেন, ওকে ভেতরে নিয়ে আয়, ওকে ভেতরে নিয়ে আয়। বড় মেয়েটি চাপা গলায় বলল, আস, ভেতরে আসা। বলেই সে অপালার হাত ধরল। যেন সে এদের অনেক দিনের পরিচিত কেউ। অপালা বলল, তোমরা কী আমাকে চোন? তারা কেউ সে প্রশ্নের জবাব দিল না। ভেতর থেকে ভদ্রমহিলা বললেন, ওকে নিয়ে আয় ওকে ভেতরে নিয়ে আয়।
চাদর গায়ে একজন মহিলা বিছানায় শুয়ে আছেন। অপালা ঘরের ভেতর পা দেয়ামাত্র তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। কান্নার দমকে তাঁর ছোট্ট শরীর থর-থর করে কাঁপছে। বড় মেয়েটি ছুটে গিয়ে তার মাকে ধরল। ফিসফিস করে বলল, কিছু হয় নাই মা, কিছু হয় নাই, তুমি চুপ কর। ভদ্রমহিলা চুপ করতে পারছেন না।
অপালা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আপনি কী আমাকে চেনেন?
ভদ্রমহিলা না-সূচক মাথা নাড়লেন।
আপনি তাহলে এ-রকম করছেন কেন?
বড় মেয়েটি একটি হাতপাখা নিয়ে তার মাকে দ্রুত হাওয়া করছে। মেজো মেয়েটি অপালার হাত ধরে বলল, তুমি বস। চেয়ারটায় বস।
অপালা বসল। হাতের শাড়ির প্যাকেটটি নামিয়ে রেখে ক্লান্ত গলায় বলল, এ বাড়ির যে মেয়েটির বিয়ে, তার জন্যে এই শাড়িটা এনেছি। বিয়ের দিন তো আসতে পারব না, তাই। বেশি লোকজন আমার ভাল লাগে না।
অপালা কী বলছে নিজেও বুঝতে পারছে না। সে যেন ঘোরের মধ্যে কথা বলছে। পাঁচটি মেয়ের কেউই তার কথা শুনছে বলে মনে হল না। সাবাই চোখ বড় বড় করে অপালার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু বড় মেয়েটি তার মাকে নিয়ে ব্যস্ত। ভদ্রমহিলা এখন আর কোনো সাড়াশব্দ করছেন না। তার চোখ বন্ধ। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছেন। বড় মেয়েটি তার মার গলা পর্যন্ত চাদর টেনে মৃদু স্বরে বলল, এস, আমরা পাশের ঘরে যাই।
উনি কি ঘুমিয়ে পড়ছেন?
হ্যাঁ। মার শরীর খুব খারাপ। মাঝে মাঝে তার এ রকম হয়।
উনি আমাকে দেখে এ-রকম করলেন কেন?
বড় মেয়েটি তার জবাব না-দিয়ে বলল, চল, পাশের ঘরে যাই।
অপালা বলল, না, আমি পাশের ঘরে যাব না। আমি এখন চলে যাব। আমার ভাল লাগছে। না। আমার একটুও ভাল লাগছে না।
সে উঠে দাঁড়াল। আবার বলল, তোমরা কী আমাকে চেন?
বড় মেয়েটি বলল, না, চিনি না।
সত্যি চেন না?
তোমার বাবা আমার বাবাকে অনেক সাহায্য করেছেন, সেই ভাবে চিনি। আমার বাবার কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। প্ৰায় না খেয়ে ছিলেন। বাবা-মা আর তাদের তিন মেয়ে। তখন তোমার বাবা আমাদের সাহায্য করেন। টাকা-পয়সা দেন। বাবাকে একটা দোকান দিয়ে দেন। সেইভাবে তোমাকে চিনি।
সেই রকম চেনায় কেউ কী আমাকে তুমি বলবে?
তুমি বলায় কী রাগ করেছ?
অপালা জবাব না-দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। সে ঠিকভাবে পা ফেলতে পারছে না। তার যেন প্রচণ্ড জ্বর আসছে। নিঃশ্বাসও ঠিকমত ফেলতে পারছে না। অপালার সঙ্গে-সঙ্গে ওরা পাঁচ জনও বেরিয়ে এসেছে। মেজো মেয়েটি অপালার হাত ধরে কী বলতে চাইল। অপালা সেই হাত কাঁপা ভঙ্গিতে সরিয়ে প্রায় ছুটে গেল রাস্তার দিকে। তার মনে হচ্ছে, সে রাস্তা পর্যন্ত যেতে পারবে না, তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে। তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে।
পাঁচ বোন দরজা ধরে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে, যেন তারা কোনো কারণে খুব ভয় পেয়েছে।
নিশানাথবাবু দোতলায় উঠে এসে
রাত দশটা।
নিশানাথবাবু দোতলায় উঠে এসে অপালার দরজায় ধাক্কা দিলেন।
মা, একটু দরজা খুলবে?
অপালা দরজা খুলল। তার চোখ লাল। দৃষ্টি এলোমেলো। নিশানাথবাবু মৃদু স্বরে বললেন, কী হয়েছে?
কই, কিছু হয়নি তো। কী হবে?
আজ তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
ম্যানেজার কাকু, আজ আমার কথা বলতে ভাল লাগছে না। আপনি এখন যান। আপনার পায়ে পড়ি।
নিশানাথবাবু আবার নিচে নেমে গেলেন। সেই রাতে তিনি আর বাড়ি ফিরলেন না। একতলার গোস্টরুমে রাত কাটালেন।