আমার সে-রকমই ধারণা।
খুবই আশ্চর্যে ব্যাপার, শাড়ির প্যাকেট হাতে অপালা ফিরোজের পেছনে পেছনে আসছে। অপালার ভালই লাগছে। কেন ভাল লাগছে তাও ঠিক বুঝতে পারছে না। এই মানুষটি তাকে দেখে অসম্ভব খুশি হয়েছে। তা ফুটে উঠেছে তার চোখে-মুখে, কথা বলার ভঙ্গিতে। তার সিগারেটে আগুন নেই। সেই নেভানো সিগারেটই সে টানছে এবং ধোয়া ছাড়বার মত ভঙ্গি করছে। লোকটি জানে না যে তার সিগারেট নেভানো। অপালার মনে ক্ষীণ একটা সন্দেহ খেলা করছে। এই সন্দেহটিকে প্রশ্রয় দেয়া বোধহয় ঠিক হবে না।
ফিরোজ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। বিস্মিত গলায় বলল, আপনি সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে আসছেন! আপনি তো আসতে বললেন।
ও হ্যাঁ, তাই তো। কথার কথা হিসেবে বলেছিলাম, সত্যি সত্যি চলে আসবেন ভাবিনি। আপনি কী রোমান হলিডে নামের কোনো ছবি দেখেছেন?
না। কেন?
যে-ঘটনাটা আমার জীবনে ঘটছে, তার সঙ্গে ঐ ছবিটার অদ্ভুত মিল আছে। ঐ ছবিতে একজন রানী এক’দিন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, সারাটা দিন কাটান একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। সন্ধ্যাবেলা আবার রাজপ্রাসাদে ফিরে যান।
আপনি এমনভাবে কথা বলছেন কেন?
আগেই তো বলেছি, আমি অসুস্থ, আমার মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। যা মনে আসছে বলে ফেলছি। আপনি চলে যাবার আগে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইব। সাবধানে উঠবেন, সিঁড়িটা পিছল।
ফিরোজ অবাক হয়ে দেখল, মেয়েটা কী সুন্দর গুটি-গুট করে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে! তার মনে হল, মেয়েটির মাথাও খানিকটা এলোমেলো। কিংবা লোকজনের সঙ্গে মিশে তার অভ্যেস নেই। সাধারণ একটি মেয়ে কখনো কোনো অবস্থাতেই এমন পরিচয়ে তার ঘরে আসবে না। ব্যাপারটির অস্বাভাবিকতা মেয়েটির চোখেই পড়ছে না, কিংবা কে জানে হযত এটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা, এটা স্বপ্নদৃশ্য নয় তো? সমস্ত ব্যাপারটা হয়ত স্বপ্নে ঘটে যাচ্ছে। না, তা নয়। ফিরোজ সেন্টের গন্ধ পাচ্ছে। ঘন নীল রঙের আকাশ দেখতে পাচ্ছে। স্বপ্ন হয় গন্ধ ও বর্ণহীন।
অপালা কৌতূহলী হয়ে দেখছে। দেখার মত কিছু নেই। অপরিচ্ছন্ন নোংরা একটি ঘর। অন্য দিন এর চেয়ে পরিষ্কার থাকে। অসুস্থ থাকার কারণে কোনো কিছুতেই হাত দেয়া হয়নি। এখনো মশারি খাটানো। মেঝেতে সিগারেটের টুকরো। ময়লা কাপড়। দু’টি শেষ না-হওয়া পেইন্টিং। রঙের টিউব, ব্ৰাশ। পিরিচে রঙ, চেয়ারে রঙ, মেঝেতে রঙ। জানালার পাশে আধা-খাওয়া চায়ের কাঁপের দিকে সারি বেঁধে লাল পিপড়ার দল যাচ্ছে। অপালা বলল, আপনি মনে হচ্ছে খুব গোছানো মানুষ।
ফিরোজ জবাব দিল না।
আপনি ড্রেস চেঞ্জ করুন, আমি বারান্দায় দাঁড়াচ্ছি।
অপালা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। সুখী সুখী চোখে তাকিয়ে রইল রাস্তার মানুষজনদের দিকে। কত ব্যস্ত হয়েই না। এরা ছুটছে, দেখে মনে হয়। এদের কারোর বিন্দুমাত্র অবসর নেই। সবার ভীষণ তাড়া।
ফিরোজ বেরিয়ে এসে বলল, আপনাকে এনে লজ্জাই লাগছে।
অপালা বলল, আমি ভেবেছিলাম। আপনার স্ত্রীকে এ বাড়িতে দেখব। এখনো বিয়ে হয়নি?
না।
হবে তো শেষ পর্যন্ত?
হ্যাঁ, হবে।
আপনি বানিয়ে বানিয়ে এ সব বলছেন না তো?
বানিয়ে বলব কেন? আমার কী স্বাৰ্থ?
তাও তো ঠিক। আচ্ছা শুনুন, একটা মজার জিনিস দেখলাম আপনার এখানে দুটো চড়ুই পাখি চা খাচ্ছে।
ওরা আমার পোষা চড়ুই। চা খাইয়ে-খাইয়ে পোষ মানিয়েছি।
আপনি কেন বানিয়ে বানিয়ে এত মিথ্যা কথা বলেন?
চড়ুইগুলো যদি কথা বলতে পারত, তাহলে এরা বলত যে এটা সত্যি। দুর্ভাগ্যক্রমে এদের কথা আমরা বুঝি না।
বাসা খুঁজে পেতে অনেক সময় লাগল। গলির পর গলি, তস্য গলি। টিনের একটা ঘর। এর আবার নামও আছে আনন্দ কুটির।
ফিরোজ বলল, আমিও কী আসব আপনার সঙ্গে?
না, আপনি কেন আসবেন?
অপেক্ষা করব এখানে?
না, আমি নিজেই চলে যাব।
আমি না হয় থাকি, আপনাকে রিকশায় তুলে তারপর যাব।
না। কেউ অপেক্ষা করে থাকলে আমার অস্বন্তি লাগে।
ফিরোজ নিজেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। প্রচণ্ড জ্বরের আগমন সে টের পাচ্ছে। চোখ মেলে রাখতে পারছে না, বমি-বমি ভাব হচ্ছে। ফিরোজের ধারণা, অপালা এটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু সে একটি কথাও বলছে না। সহজ ভদ্রতার দু’টি কথা কি বলা যায় না? সে যদি জিজ্ঞেস করে–আপনার কী খুব খারাপ লাগছে নাকি? তাতে তো জগৎ-সংসারের কোনো ক্ষতি হবে না। ফিরোজ বলল, হয়ত ওরা বাসায় নেই, কোথাও বেড়াতে-টেড়াতে গিয়েছে। আমি দাঁড়াচ্ছি, আপনি খোঁজ নিয়ে আসুন।
অপালা হেসে ফেলল। ফিরোজ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, আপনি হাসছেন? এখন বাচ্চাদের পরীক্ষটরীক্ষা হয়ে গেছে, এই সময়ই সবাই নানার বাড়িতে বেড়াতে যায়।
যে-বাড়িতে যাচ্ছি, তাদের বড় মেয়েটির বিয়ে, কাজেই ওরা কোথাও যাবে না। হয়ত দল বেঁধে কেনাকাটা করতে গিয়েছে। বড় মেয়ের বিয়েতে দল বেঁধে কেনাকাটা হয়। আমার বড় বোনের বিয়ের সময় দেখেছি। কাজের মেয়েটিকে পর্যন্ত আমরা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছি। ঘর তালাবন্ধ করে গেলাম, ফিরে এসে দেখি চোর সব সাফা করে দিয়েছে।
ফিরোজ সাহেব।
জি।
এখন চলে যান। প্লিজ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গে তর্ক করতে ভাল লাগছে না।
ফিরোজ গেল না। একটু শুধু সরে গেল। তার কেন জানি মনে হচ্ছে অপালা এক্ষুণি বেরিয়ে আসবে। তখন তার সঙ্গে অনেকক্ষণ হাঁটা যাবে। পাশাপাশি সাত পা হাটলে সাত পাকে বাঁধা পড়ে। অনেক বেশি পা হাঁটা হয়েছে। আরো হোক। সে লক্ষ পা হাঁটবে।