মেয়েটির মধ্যে রহস্য আছে! সে তো সব মেয়ের মধ্যেই আছে। মেয়ে মানেই তো রহস্য। আনসলভড মিস্ট্রি।
মেয়েটি অন্য কোনো মেয়ের মত নয়। এটা কোনো কথা হল না। কোনো মেয়েই অন্য কোনো মেয়ের মত নয়। প্রতিটি মেয়েই আলাদা।
ফ্রয়েডীয় তাত্ত্বিকদের মত চিন্তা করা যাক। এই মেয়েটির চেহারা বা আচার-আচরণে কোথাও ফিরোজের মার সঙ্গে মিল আছে। মায়ের সঙ্গে মিল আছে সেই জাতীয় মেয়ের প্রতি পুরুষেরা প্রচণ্ড আকর্ষণ বোধ করে। বোগাস কথা! ফিরোজের মা ফিরোজের জন্মের সময় মারা যান। সেই মহিলার কোনো স্মৃতি ফিরোজের মনে থাকার প্রশ্নই উঠে না।
মেয়েটির প্রচুর টাকা-পয়সা–এটা কি একটা কারণ হতে পারে? না, হতে পারে না। টাকার লোভ ফিরোজের আছে, তবে তা নিশ্চয়ই খুব প্রবল নয়। প্রবল হলে সিনেমার কাজ ছেড়ে দিত না। মোটামুটি ভাল টাকা পয়সার একটা সম্ভাবনা ঐ লাইনে ছিল।
অপালাদের বাড়ির সামনে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। এর মানে কী? মেয়েটির বাবা কি মন্ত্রীফন্ত্রী হয়ে গেলেন নাকি? পয়সাওয়ালা লোকজন হঠাৎ করে মন্ত্রী হয়ে যান। ইনিও হয়ত হয়েছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী কিংবা পাটমন্ত্রী। আচ্ছা, দেশে পাটমন্ত্রী আছে, চা-মন্ত্রী নেই কেন?
রপ্তানিযোগ্য প্রতিটি আইটেমের ওপর একজন করে মন্ত্রী থাকলে ভালো হত। চামড়া-মন্ত্রী, রেডিমেড গার্মেন্ট-মন্ত্রী, চিংড়ি-মন্ত্রী। সবচেয়ে ভাল হয়। একজন ব্যাঙ-মন্ত্রী থাকলে। ব্যাঙও তো আজকাল রপ্তানি হচ্ছে। তবে এই দপ্তর হতো। কেউ নিতে চাইবে না। কে আর সখ করে ব্যাঙ-মন্ত্রী হবে?
অপালাদের গেটে বিশাল একতালা, এ-ও রহস্যজনক। দিনে-দুপুরে গেটে তালা থাকবে কেন? দারোয়ান ব্যাটা টুলে বসে আছে। ফিরোজকে দেখেও সে বসে রইল। এটাই স্বাভাবিক। সে যদি চট করে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বসত, তাহলেই অস্বাভাবিক হত।
এই যে দারোয়ান, গোটটা খোল।
দারোয়ান তাকে ভালই চেনে। ফিরোজ বেশ কিছুদিন এ-বাড়িতে কাজ করেছে, তাকে না। চেনার কোনোই কারণ নেই। দেখা হয়েছে দুবেলা। তবু এই ব্যাটা এমন করে তাকাচ্ছে, যেন ফিরোজ খুনের পলাতক আসামি–। এই বাড়িতে আশ্রয়ের খোঁজে এসেছে।
আফনে কার কাছে যাইবেন?
তোমার আপার কাছে। উনিই আসতে বলেছেন।
দাঁড়ান, খবর দেই।
দারোয়ান গেট খুলল না। খবর দেবার জন্যে রওনা হল। গদাইলস্করি চাল বোধহয় একেই বলে। দশ মিনিট পর-পর একেকটা পা ফেলছে। এভাবে হাঁটলে বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে রাত এগারটা বাজবো।
ফিরোজ অতি দ্রুত এ বাড়িতে উপস্থিত হবার অজুহাত মনে মনে সাজিয়ে ফেলতে চেষ্টা করল। সেই সঙ্গে কী কথাবার্তা হবে, তা নিয়ে একটা স্টেজ রিহার্সল। মেয়েটি এসেছে। মুখ হাসি-হাসি। ফিরোজ বলছে–হঠাৎ এসে বিরক্ত করলাম। মেয়েটি বলল–না না, বিরক্ত কিসের, এসেছেন খুশিই হয়েছি। আসুন, একসঙ্গে চা খাওয়া যাবে। খুব লোনলি ফিল করছিলাম। অ্যাজ এ ম্যাটার অব ফ্যাক্ট, মনে হচ্ছিল। আপনি আসবেন।
আমার বিয়েটা ভেঙে গেল, ঐ খবরটা দিতে এসেছিলাম।
বিয়ে ভেঙে গেল নাকি?
হ্যাঁ। মেয়ের আমেরিকা প্রবাসী চাচা আমাকে পছন্দ করলেন না।
আমিও তাই ভেবেছিলাম। এখন দেখছি সেটা ঠিক না। ভীষণ মন-খারাপ হয়ে গেছে। সুরা দুপুর ওয়ে ওয়ে সুইসাইড করার কথা ভাবলাম। এখন যে ভাবছি না, তা নয়। এখনো ভাবছি।
ছিঃ, এ সব ভাবনা মনেও আনবেন না। আমার এখানে এসেছেন ভাল করেছেন, গল্প করে মন হালকা করুন।…
চিন্তা এই পর্যন্তই এসে কেটে গেল। দারোয়ান গদাইলস্করি চালে ফেরত আসছে। ব্যাটার মুখ অন্ধকার। নিশ্চয়ই এতক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্যে দাবড়ানি খেয়েছে।
আপা কী বলল?
আফনেরো চইল্যা যাইতে কইছে।
চলে যেতে বলেছে?
জি।
আমার কথা বলেছিলে ঠিকমত?
জি, বলছি।
কী বলেছি?
বলছি, ঐ যে ভদ্রলোক ঘর সাজাইয়া দিছে হে আসছে…
আর তোমার আপা কী বলল?
এক কথা কয়বার কম, কন। চইল্যা যাইতে কইছে।
ফিরোজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করছে। পারছে না। হাত কেঁপে যাচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো পুলিশটি সহানুভূতির চোখে তাকাচ্ছে। খাকি পোশাক পরা কেউ সহানুভূতি দেখাতে পারে, এটা ফিরোজের কল্পনায় ছিল না। সে কেমন যেন অপ্রস্তুত বোধ করতে লাগল। ছুটে পালিয়ে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল হত। তা করা যাচ্ছে না। তাকে হেঁটে-হেঁটে সদর রাস্তা পর্যন্ত যেতে হবে, এবং যতক্ষণ তাকে দেখা যাবে ততক্ষণ পুলিশ এবং দারোয়ান তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তাদের চোখে থাকবে সহানুভূতি ও করুণা।
ফিরোজ মাথা নিচু করে পা বাড়াল। হাতের সিগারেটটি নিভে গেছে। আবার ধরাতে ইচ্ছে করছে না। কোথায় এখন যাওয়া যায়? যাবার তেমন কোনো জায়গা নেই। তাজিন আপার কাছে যাওয়া যেতে পারে। অনেক দিন যাওয়া হয়নি। মনসুরের বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ ওকে বিরক্ত করা যেতে পারে। নতুন বিয়ে করেছে। সন্ধ্যার পর কেউ বেড়াতে গেলে অসম্ভব বিরক্ত হয়। মুখ হাড়ির মত করে রাখে, একটু পর পর ঘড়ির দিকে তাকায়, রাত আটটা বাজতেই লোক দেখানোর হাই তুলতে শুরু করে।
মনসুরের ওখানেও যেতে ইচ্ছে করছে না। আজ সারারাত পথে-পথে হাঁটলে কেমন হয়? এই পাগলামির বয়স কি তার কাছে?
ফিরোজের ঠাণ্ডা লাগছে। ইচ্ছে করেই আজও পাতলা একটা শার্ট গায়ে দিয়ে এসেছিল। যদি অপালা পাতলা শার্ট নিয়ে ঐ দিনের মত কিছু বলে!
ফিরোজ অনেক রাত পর্যন্ত পাতলা জামা গায়ে দিয়ে শহরে ঘুরে বেড়াল। এক সময় তার মাথা ভারী হয়ে এল। বোঝাই যাচ্ছে, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশপাতাল ১ জ্বর আসবে। আসুক। পেতেছি সমুদ্রে শয্যা শিশিরে কি ভয়?
রান্নাঘরে নিশানাথবাবুর স্ত্রী
রান্নাঘরে নিশানাথবাবুর স্ত্রী চারদিকে বাসনপত্র ছড়িয়ে কী-সব যেন করছেন। বাবুর্চি গোমেজ, চোখ-মুখ কুঁচকে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে। গোমেজ এই মহিলাটিকে পছন্দ করছে না। এই মহিলা সরাসরি তার সাম্রাজ্যে হস্তক্ষেপ করছে। যখন-তখন রান্নাঘরে ঢুকে জিনিসপত্র এলোমেলো করে দিচ্ছে। এখন আর কোনো কিছুই হাতের কাছে পাওয়া যায় না। গতকাল। লবণের কৌটা খুঁজতে তার দশ মিনিট লেগেছে। অথচ লবণের কৌটা থাকে। দ্বিতীয় তাকের সবচেয়ে প্রথমে। আগে চোখ বন্ধ করে বের করতে পারত।