হেলেনা।
বল।
চল, একটু হেঁটে আসি।
কোথায় হাঁটবে?
এই বাগানেই হাঁটব। বেশি দূর যাব না। তোমার হাঁটাহঁটিতে কোনো বাধা নেই তো?
না, নেই।
গুড। গায়ে ওভারকোট জাতীয় কিছু একটা চাপিয়ে এস।
ছবির মতো সুন্দর বাগান। এত সুন্দর যে কৃত্রিম মনে হয়। বড় বেশি সাজানো। ফখরুদ্দিন সাহেব মাঝে মাঝে কাশছেন, কিন্তু কোনো কথাই বলছেন না। হেলেনা হঠাৎ বললেন, তুমি যে খুব অসুস্থ, একটা হাসপাতালে আছ, এই খবর কিন্তু আমি জানি।
জানলে তো ভালই।
অন্যের কাছ থেকে জানতে হল।
ফখরুদিন সাহেবের চুরুট নিভে গিয়েছিল, অনেক কায়দা করে সেটা ধরাতে হল। তিনি কিছু বললেন না।
আমাকে খবরটা না জানানোর পেছনে তোমার যুক্তিগুলি কি, একটু বল তো শুনি।
কোনো যুক্তি নেই। এস, কোথাও একটু বসা যাক। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।
তারা বসলেন। হেলেনা মৃদু স্বরে বললেন, এখনো কি তুমি বিশ্বাস কর, টাকা দিয়ে সব পাওয়া যায়?
হ্যাঁ, করি।
মানুষ হিসেবে তুমি কি সুখী?
হ্যাঁ, সুখী। তোমার মত বানানো দুঃখ-কষ্ট আমার নেই। আমার বুদ্ধিবৃত্তি নিম্নস্তরের। আমার মত মানুষের কোনো কাল্পনিক দুঃখ-কষ্ট থাকে না। ঐ সব থাকে খুব উচ্চমার্গের লোকদের।
আমার কিন্তু ধারণা, তুমি খুব দুঃখী মানুষ।
তাই নাকি? ভেরি ইন্টারেস্টিং।
তুমি যে খুব দুঃখী, এটা তুমি নিজেও জানো।
ফখরুদ্দিন সাহেব চুরুটটা ছুড়ে ফেললেন। ঢালু জায়গা পেয়ে চুরুটটা গড়াতে গড়াতে নিচে নামছে। সেই দিকে তাকিয়ে বিদ্যুতের মতো তার মাথায় এল, মানুষের জীবনও কি এ-রকম গড়িয়ে যাওয়া নয়? কেউ কিছু দূর গিয়ে আটকে যায়, আবার কেউ যেতেই থাকে। এমন কিছু উচ্চশ্রেণীর দার্শনিক চিন্তা নয়, তবু ফখরুদিন সাহেবের বেশ ভাল লাগছে। তিনি পকেট থেকে আরেকটি চুরুট বের করে গড়িয়ে দিলেন। হেলেনা বললেন, কি করছ?
এক ধরনের খেলা, তুমি বুঝবে না?
না-বোঝারই কথা। তোমার বেশির ভাগ কাজকর্মই আমি বুঝি না।
তুমি কি করে বুঝবে বল, আমি নিজেই বুঝি না।
বলতে বলতে ফখরুদিন সাহেব খুব হাসলেন। হাসতে-হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। হেলেনা বললেন, তোমার অসুখটা কী?
জানি না, কি। ডাক্তাররা জানার চেষ্টা করছে। কেন জানি মনে হচ্ছে, ডাক্তাররা খুঁজে খুঁজে একটা খারাপ অসুখই বের করবে। রাজকীয় কোনো অসুখ। ডায়রিয়া বা আমাশার মত অসুখে আমাকে মানাবে না; এইসব হচ্ছে ভিখিরিদের অসুখ। আমি কী ভিখিরি? হা হা হা।
লন্ডনের আকাশ আজ ঘন নীল। বাতাস মধুর। রোদের রঙ কাঁচা সোনার মত। অদ্ভুত সুন্দর একটি দিন। ফখরুদিন সাহেব এমন চমৎকার একটি দিনেও খানিকটা বিষন্ন হলেন। সুনীল আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। হেলেনা বললেন, আজ তুমি অপালার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলো।
কেন বল তো?
ওর বোধহয় খুব মন-খারাপ। কি-একটা দুঃস্বপ্ন দেখে খুব কেঁদেছে। আমাকে বলতে বলতে ও কাদাল।
কী দুঃস্বপ্ন?
একটা ছোট্ট মেয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, এইসব কি হাবিজাবি!
দুঃস্বপ্নটা কী, তা তো বুঝলাম না। রাক্ষস-খোক্ষস স্বপ্নে দেখলেও না হয় কথা ছিল। ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তো কী হয়েছে?
হেলেনা ক্লান্ত গলায় বললেন, মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখেও মানুষ ভয় পায়। তুমি ওর সঙ্গে কথা বলবে।
আমি এক্ষুণি টেলিফোন করছি।
ফখরুদিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
ফিরোজের দুপুরে ঘুমানোর অভ্যেস নেই
ফিরোজের দুপুরে ঘুমানোর অভ্যেস নেই।
তার ধারণা গৃহী টাইপের মহিলা এবং ডায়াবেটিক প্রৌঢ়রাই নিয়ম করে দুপুরে ঘুমায়। একজন ইয়ংম্যান, যার রক্তে উত্তেজনা টলমল করছে, তার দুপুরে ঘুমানোর প্রশ্নই উঠে না। ফিরোজের ধারণা, সে নিজে একজন ইয়াংম্যান এবং তার রক্তে উত্তেজনা। টলমল করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এইসব ধারণা থাকা সত্ত্বেও গত কয়েক দিন ধরে তাকে নিয়মিত ঘুমুতে দেখা যাচ্ছে। মশারি খাটিয়ে বেশ একটা আয়োজনের ঘুম।
মশারি খাটানোর কারণ হচ্ছে, এ-বাড়ির মশারা দিন এবং রাত্রির পার্থক্য বোঝে না। এরা দিনে বেশি কামড়ায়।
দুপুরে ঘুমানোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, ঘুম ভাঙলেই বিচিত্র কারণে মন স্যাতসোঁতে হয়ে থাকে। কোনো কিছুই ভাল লাগে না। মন-খারাপ ভাব কিছুতেই কাটতে চায় না। ফিরোজের ধারণা, বেশির ভাগ যুবক আত্মহত্যা করে দুপুরে ঘুমের পর। একটি উদাহরণ তার কাছে আছে। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সমু, এক দুপুরে লম্বা ঘুম দিয়ে উঠল। চায়ের দোকানে চা খেয়ে এসে দীর্ঘ একটি চিঠি লিখল। সেই চিঠিতে কোনো সম্বোধন নেই, কাজেই বোঝা গেল না। কাকে লেখা। চিঠি শেষ করে তাদের তিনতলার ছাদ থেকে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ল।
দুপুরবেলায় ঘুমুলে ফিরোজেরও এ-রকম নাটকীয় কিছু করতে ইচ্ছে করে। এই মুহূর্তেই করছে। সে বারান্দায় কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটল, তারপর ঠিক করল অপালা মেয়েটির সঙ্গে এক কাপ চা খাবে। সে-বাড়িতে যাবার জন্যে একটা অজুহাত ভেবে-চিন্তে বের করতে হবে। সেটা যে এখনই বের করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। পথে যেতে যেতে ভাবলেই হবে।
এই মেয়েটি তাকে এত ভোগাচ্ছে কেন? রোজ খানিক্ষণের জন্যে হলেও এর কথা মনে পড়ে। এটা মোটেও ভাল লক্ষণ নয়। আসল কথা হল, কেন বার বার মনে পড়ছে?
মেয়েটি রূপবতী! এটা এমন কোনো ব্যাপার নয়। এ শহরে প্রচুর রূপবতী মেয়ে আছে। এদের কারো কারো সঙ্গে তার পরিচয়ও আছে। কই, ওদের কথা তো মনে পড়ে না!