অপালা তার নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। দুপুরে ভাত খাবার সময় কাজের মেয়েটি ডাকতে এল। অপালা বলল, বিরক্ত করবে না। আমি কিছু খাব না। বিকেলে চা খাওয়ার জন্যেও নামিল না। সন্ধ্যাবেল নিশানাথবাবু এসে দরজায় টোকা দিলেন। সে খুব স্বাভাবিকভাবে দরজা খুলল। সহজ স্বরে বলল, কেমন আছেন ম্যানেজার কাকু।
ভাল আছি মা।
কারখানায় কী-সব ঝামেলা?
ঝামেলা তো আছেই মা। বিষয়-সম্পত্তি মানেই হচ্ছে ঝামেলা। একমাত্র সাধু-সন্ন্যাসীরাই ঝামেলামুক্ত।
দু’জন নাকি মারা গেছে?
হুঁ। নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করে মরেছে, দোষ পড়েছে মালিকপক্ষের। তুমি এই নিয়ে কোনো চিন্তা করবে না। আসগর সাহেব চলে এসেছেন, উনি দেখছেন। খুবই কাজের লোক।
আসগর সাহেব কে?
আমাদের চিটাগাং ব্রাঞ্চের জি.এম, উনি একতলায় বসে আছেন। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
আমার সঙ্গে কিসের কথা?
স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বড় রকমের ডিসিশনের ব্যাপার। তুমি একটু নিচে এস মা।
আসগর সাহেব মানুষটি সুপুরুষ। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। গোলগাল ভালমানুষের মত মুখ। কথা থেমে-থেমে বলেন। মনে হয় প্রতিটি শব্দ বলার আগে খানিক্ষণ ভাবেন। অপালা ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালেন, এবং অপালা না-বসা পর্যন্ত নিজে বসলেন না।
খুবই দুঃখিত যে আপনাকে ডিসটার্ব করতে হচ্ছে। মাই অ্যাপোলজি। এদিকে স্যার অসুস্থ, স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।
কী বলবেন, বলুন।
দু লাখ টাকার মত খরচ করেল ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এক লাখ দিতে হবে ইউনিয়নকে। ওদের ঠাণ্ডা করতে হবে। পুলিশকে দিতে হবে বড় এ্যামাউন্ট। তা ছাড়া…
ভদ্রলোকের কথার মাঝখানেই অপালা বলল, এতে কি মালিকপক্ষের দোষই স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে না? সবাই কি তাহলে ভাববেন না, এটা আমরাই করিয়েছি?
আসগর সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, আমরা যে ধোয়া তুলসীপাতা, তাও কিন্তু না মিস অপালা। ছোট হলেও আমাদের একটা ভূমিকা আছে।
ও-আচ্ছা, আছে তাহলে!
আপনার সেফটির ব্যাপারটাও দেখতে হয়। আপনার নিরাপত্তা হচ্ছে আমাদের টপ প্ৰায়োরিটি।
আমার নিরাপত্তার ব্যাপারটা আসছে কেন?
প্রতিশোধের ব্যাপার। আর কি। ধরুন, একটা হাতবোমা এসে ফেলে দিল, অ্যাসিড ছুঁড়ে মারল…
অপালা চুপ করে রইল। আসগর সাহেব বললেন, আগেও এ রকম ঝামেলা হয়েছে।। টাকা পয়সা দিয়ে মিটমাট করা হয়েছে। অবশ্যি এত বড় স্কেলে ঝামেলা হয়নি। দিস টা…
আপনারা যা ভাল মনে করেছেন, তা করাই ভাল।
আপনাকে একটা অনুরোধ, এক-একা বাইরে যাবেন না। সবচেয়ে ভাল হয়, প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে না বেরুলে।
আমি এমনিতেই ঘর থেকে বের হই না।
ডি.সি সাউথকে আমি অবশ্যি রিকোয়েস্ট করেছি। কয়েক দিনের জন্যে বাড়ির সামনে একটা ফিক্সড সেন্ট্রির ব্যবস্থা করতে। কথায় আছে না, প্ৰিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর? আজ তাহলে উঠি। আপনাকে কষ্ট দিলাম।
রাতে অপালা অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল। যেন বিকেল হয়েছে। সূর্য ডুবে যাবার আগের মায়াবী আলো চারদিকে। সে একা-একা বাগানে হাঁটছে। হঠাৎ কে যেন ডাকল—এই…এই। অপালা চমকে তাকাল কেউ তো কোথাও নেই! কে ডাকল! অপালা ভয়-পাওয়া গলায় বলল, কে ডাকছে আমাকে?
আমি। আমি ডাকছি। আপনাকে।
অপালা দেখল, গেটের বাইরে সেই এগার-বার বছরের মেয়েটি দাঁড়িয়ে, যে তার বাবার সঙ্গে ঘরে ঢোকেনি। এক-একা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল।
নাম কী তোমার?
মেয়েটি নাম বলল না। খুব হাসতে লাগল।
ঐ দিন তুমি ঘরে ঢোকনি কেন? কেন তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলে?
এই প্রশ্নেরও কোনো জবাব দিল না মেয়েটি। অপালার বুক কাঁপতে লাগল, কারণ এই মেয়েটিকে তার চেনা-চেনা লাগছে। খুব চেনা–অসম্ভব চেনা। কিন্তু তবুও অচেনা।
এ কেমন স্বপ্ন!! ঘুম ভাঙার পরও অপালার হাত-পা কাঁপছে। পানির পিপাসায় বুক শুকিয়ে কাঠ। তার খুব ইচ্ছে করছে চেঁচিয়ে কাঁদে।
ঐ মেয়েটিকে সে কেন স্বপ্নে দেখল? মানুষের অবচেতন মনে কত রহস্যই-না খেলা করে। কোনো দিন মানুষ তা জানতে পারে না। অপালার বড় জানতে ইচ্ছে করে।
হেলেনা ভিজিটার্স রুমে
হেলেনা ভিজিটার্স রুমে ঢুকে একটু অবাক হলেন।
ফখরুদিন সাহেব বসে আছেন। তার হাতে জ্বলন্ত চুরুট। হেলেনা অবশ্যি তার বিস্ময় গোপন
করলেন। সহজ স্বরে বললেন, কেমন আছ?
খুব ভাল।
চুরুট টানছ? স্মোকিং এখানে নিষিদ্ধ। দেয়ালে লেখা চোখে পড়েনি?
পড়েছে। দেয়ালে লেখা ধূমপান না করার জন্যে অনুরোধ করছি। আমি অনুরোধটা রাখলাম ना। হা হা হা।
তোমার কী শরীর খারাপ?
না, শরীর বেশ ভালই আছে।
কোথায় ডুব দিয়েছিলে?
আশপাশে ছিলাম। তোমার অবস্থা কি?
ভাল।
কী-রকম ভাল?
বেশ ভালো। অপারেশনটা লাগবে না। ইচ্ছা করলে দেশে ফিরে যেতে পারি।
ইচ্ছা করছে?
হেলেনা জবাব দিলেন না। ফখরুদ্দিন সাহেব বললেন, এই মুহূর্তে দেশে ফিরতে পারছি না। এখানে আমার কিছু কাজ আছে। কাজ শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ক’দিন লাগবে কাজ শেষ হতো?
দিন দশেক লাগবে।
কি কাজ?
ফখরুদ্দিন সাহেব এ-প্রশ্নের জবাব দিলেন না। ডাক্তাররা তার শরীরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চায়। দিন দশেক সময় এই কারণেই তারা চাচ্ছে। হেলেনাকে তা বলার তিনি কোনো প্রয়োজন বোধ করছেন না। আজ যে হাসপাতাল থেকে বের হয়েছেন, সেও বহু কষ্টে। বলে এসেছেন। দুঘণ্টার মধ্যে ফিরবেন। তাও সম্ভব হবে কি না কে জানে? দুঘণ্টার এক ঘণ্টা তো এখনই শেষ।